Post Updated at 15 Mar, 2024 – 12:18 PM
যাকাত আদায়ের খাতসমূহ
যাকাত কাদেরকে দিতে হবে, এ নিয়ে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে বলা হয়েছে :
সাদাকা তো কেবল ফকির, মিসকিন ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্যে, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্যে, দাসমুক্তির জন্যে, ঋণ ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্যে। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।
এ আয়াতে যাকাতের আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে। এ খাতসমূহের বিশ্লেষণ নিয়ে যদিও মুজতাহিদ ইমামদের মাঝে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে, মতভিন্নতা আছে যাকাত সবগুলো খাতেই দিতে হবে, না কোনো একটিতে দিলেই চলবে, তবে এ নিয়ে কোনো মতভিন্নতা নেই যে, আয়াতে বর্ণিত আট খাতের বাইরে কাউকে যাকাত দেয়া যাবে না।
আমাদের হানাফী মাযহাব অনুসারে, যাকাত সবগুলো খাতেই দিতে হবে না। বরং কোনো একটিতে কেউ নিজের যাকাত আদায় করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, যাকাত অবশ্যই কাউকে মালিক বানিয়ে দিতে হবে। তৃতীয়ত, যাকাতগ্রহীতাকে অবশ্যই দরিদ্র হতে হবে।
যাকাত আদায়ের ৮টি খাতের হিকমত
স্বভাবতই এ প্রশ্ন সামনে আসে, যাকাতগ্রহীতাকে যদি দরিদ্রই হতে হয়, তবে আটটি খাতের কথা কেন বলা হলো? প্রথম দুটি খাত—ফকির-মিসকিন বলাটাই তো যথেষ্ট ছিল। মুফাসসিরগণ এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে, যাকাত গ্রহণের জন্যে দরিদ্রতার শর্ত থাকা সত্ত্বেও আরও কিছু খাতের কথা এখানে বলা হয়েছে, যেমন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। এর অর্থ হলো, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি একদিকে দরিদ্র, আবার সে ঋণের ভারে জর্জরিত। তার মধ্যে যেমন দরিদ্রতার শর্তটি পাওয়া যায়, আবার তাকে যাকাত দিলে তাকে ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করার চেষ্টাও করা হয়। এ দিক থেকে বলা যায়, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে যাকাত দিলে ব্যক্তি দুটি সওয়াব পেতে পারে। একই কথা দাসমুক্তি, অভাবী মুসাফির ও ‘আল্লাহর পথে’ নিয়োজিত ব্যক্তিকে যাকাত দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
একই বিবেচনায় এ কথাও বলা যায়, কেউ যদি নিরেট একজন দরিদ্র মানুষকে যাকাত দেয়, তবে তো তার যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু যাকাতগ্রহীতার মধ্যে যদি আরও কোনো বিষয় থেকে থাকে, যেমন, যাকাতগ্রহীতা যাকাতদাতার আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশী, তবে যাকাত আদায়ের পাশাপাশি আত্মীয় ও প্রতিবেশীর হক আদায়ের সওয়াবও এতে পাওয়া যাবে।
যাকাত প্রদানের বিষয়ে কয়েকটি সতর্কতা
যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। তাই এই ইবাদত সঠিক ভাবে আদায় করার বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। নিচে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো।
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে যাকাত প্রদান
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হলে তার হাতে কিংবা তার কোনো প্রতিনিধির হাতে যাকাতের টাকা তুলে দিতে হবে। কেউ যদি ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে যাকাতের টাকা হাতে না দিয়ে নিজের পাওনা মাফ করে দেয়, তবে এতে যাকাত আদায় হবে না।
দাসমুক্তির জন্য যাকাত প্রদান – (বর্তমানে এ খাতে যাকাত প্রদানের সুযোগ নেই)
দাসমুক্তির জন্যে যাকাতের টাকা ব্যয় করার বিধান রয়েছে। অর্থাৎ কোনো দাস যদি তার মনিবের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে তার মনিবকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেবে এবং এর বিনিময়ে সে আজাদ হয়ে যাবে, তবে এমন দাসকে দাসত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্যে যাকাত প্রদান করা যাবে। এ দাসকে পরিভাষায় ‘মুকাতাব’ বা চুক্তিবদ্ধ দাস বলা হয়। এখনকার সময়ে যেহেতু দাসপ্রথা নেই, তাই এ খাতে এখন আর যাকাত প্রদানেরও সুযোগ নেই। স্বাধীন কোনো বন্দী ব্যক্তিকে কারাগার থেকে বের করার জন্যে যাকাত দেয়া যাবে না, যদি না সে দরিদ্র হয়।
ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে যাকাত প্রদান
আয়াতে উল্লেখিত সপ্তম ব্যয়খাত- ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে। এ শব্দটির ব্যাখ্যায় অধিকাংশ মুফাসসির ও ফকীহের মত হলো, এখানে আল্লাহর পথে সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত যোদ্ধাগণ উদ্দেশ্য। অর্থাৎ কোনো যোদ্ধা যদি দরিদ্রতার কারণে যুদ্ধে যেতে না পারে, তবে তাকে যাকাতের টাকা দেয়া যাবে।
কেউ কেউ হজ ও ইলম অন্বেষণকেও এ খাতের আওতাভুক্ত করেছেন। কারণ এ দুটি বিষয়কে ভিন্ন ভিন্নভাবে হাদীসে সাবীলুল্লাহ বা আল্লাহর পথ বলা হয়েছে। অর্থাৎ হজ আদায়কারী ও ইলম অন্বেষণকারী যদি দরিদ্র হয়, তবে তাকে এ খাতের আওতায় যাকাত দেয়া যাবে।
ইমামদের কেউ কেউ এর আওতাকে আরও বিস্তৃত করেছেন। তারা বলেছেন, যে কোনো ভালো কাজই আল্লাহর পথ। অর্থাৎ যে কোনো ভালো কাজে নিয়োজিত কেউ যদি অভাবী হয়ে পড়ে, তবে সে-ই এ খাতের আওতাভুক্ত। তাকে যাকাত দিলে যাকাতও আদায় হবে, আবার সে ভালো কাজে সহযোগিতার সওয়াবও হবে।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ ক্ষেত্রেও মালিক বানিয়ে দেয়া শর্ত। তাই মসজিদে, রাস্তাঘাট নির্মাণে, দ্বীন প্রচারে কিংবা যে কোনো জনকল্যাণমূলক খাতে যাকাত দেয়া যায় না। মসজিদ-মাদরাসার নির্মাণ খাতে কিংবা বেতনভাতা দেয়ার জন্যে যাকাত দেয়া যাবে না। ওয়াজ মাহফিল, দীনি বইপুস্তক প্রচার কিংবা দীন প্রচারের কোনো মিডিয়াতেও যাকাত দেয়া যাবে না। মাদরাসায় যাকাত দিলে তা দিতে হবে পুওর ফান্ড। যেখান থেকে তা দরিদ্র ছাত্রদের জন্যে ব্যয় করা হবে। তবে মাদরাসার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্যে কেউ যদি মাদরাসার পুওর ফান্ডে যাকাত দেয়, এতে যাকাত আদায়ের পাশাপাশি দীনি ইলম শিক্ষা করার মতো একটি ফজিলতপূর্ণ কাজে সহযোগিতার সওয়াবও হবে, ইনশাআল্লাহ।
কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে যাকাতের টাকা বিতরনের দায়িত্ব দেয়ার আগে চাই বাড়তি সতর্কতা
যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। তাই নিজে কোনো অসহায় মানুষের হাতে যাকাতের টাকা তুলে না দিয়ে যদি আমরা এর দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে চাই। যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আমরা আমাদের নিজেদের যাকাত আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করতে চাই। তবে অবশ্যই সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দ্বীনদারী ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া উচিত। যাকাতের টাকা যাকাতের হকদারদের মাঝে শরীয়তের বিধান মোতাবেক বন্টিত হবে- এই বিশ্বাস যাদেরকে নিয়ে করা যায়, তাদের হাতেই নিজেদের যাকাত আদায়ের দায়িত্ব দেয়া উচিত।
আমাদের দেশে অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এরকম কোনো প্রতিষ্ঠানে যাকাত প্রদানের আগে আপনার নিকট আস্থাভাজন কোনো আলেমের সাথে পরামর্শ করে নিলে উত্তম হবে ইনশাআল্লাহ।
কেমন দরিদ্রদের যাকাত দেয়া যায়
যদি কারও কাছে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের সম্পদ থাকে। তা জাকাতযোগ্য সম্পদ তথা সোনারুপা টাকাপয়সা বা ব্যবসার সম্পদ হোক, কিংবা অন্য সম্পদ। যেমন: প্রয়োজন-অতিরিক্ত আসবাবপত্র জামাকাপড় বা জায়গা-জমি হোক, তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। কারও এসব সম্পদের পরিমাণ যদি সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের চেয়ে কম হয়, তবে তাকে যাকাত দেয়া যাবে।
নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদ, যেমন, বসবাসের বাড়ি, প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, প্রয়োজনীয় জামাকাপড়, জীবনধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় জমি ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে হিসাব করতে হবে না। প্রয়োজন-অতিরিক্ত সম্পদ যদি সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয়ে যায়, তবে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। আর সোনারুপা ব্যবহৃত হোক বা না হোক, টাকাপয়সা যে কোনো উদ্দেশ্যেই জমানো থাকুক, এসব হিসাব করতে হবে।
Leave a Reply