Post Updated at 22 Oct, 2023 – 7:04 PM

সামনেই অক্টোবর। এ মাসেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার আয়োজন হয়ে থাকে। দশটি হাত বিশিষ্ট একটি রঙ্গিন মূর্তি বানিয়ে সযত্নে তাকে পূজামন্ডপে স্থাপন করে। একে ঘিরে চলতে থাকে নানা রকম আচার। অবশেষে পূজ্য এ দেবীকে পানিতে ডুবিয়ে বিসর্জন দিয়ে সমাপ্ত করে তারা তাদের পূজার পর্ব। এসবই হিন্দুদের ধর্মের অংশ। তাদের ধর্ম তারা নির্বিঘ্নে পালন করুক⸺এটা আমাদেরও চাওয়া।

কিন্তু এ দুর্গাপূজা আসলেই যে কথাটি বাতাসে ভাসতে থাকে তা হলো⸺ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এ কথা আমরাই বলি, আমাদের সমাজের মুসলমানরাই বলে, সাধারণ মানুষও বলে, নেতানেত্রীরাও বলে। এ কথা বলে বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা হিন্দুদের এ প্রতিমাপূজার উৎসবে। এমন কথাও শুনতে হয়⸺পূজায় হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি! কথা হলো, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে উৎসব সেখানে একজন মুসলমানের অংশগ্রহণ কতটা যুক্তিসঙ্গত? তার ধর্ম ইসলামই বা তাকে কতটা সুযোগ দেয় অন্য ধর্মের উৎসবে অংশগ্রহণ করার? এটা কি উদারতা, না বিশ্বাসের বিসর্জন⸺এ প্রশ্নও আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। আর যে বুলিটা আমরা আওড়িয়ে থাকি, তারই বা বাস্তবতা কতটুকু?

 

এসব পূজায় আমাদের মুসলিম সন্তানদের অংশগ্রহণের ব্যাপকতা আঁচ করার জন্যে পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত একটি উদ্ধৃতি দিই। যতি দাস কুন্ডু নামের এক হিন্দু ভদ্রলোক লিখেছেন ঢাকার কলাবাগান মাঠে ২০০৭ সালে কীভাবে দুর্গাপূজার সূচনা হয় সেই ইতিহাস। তিনি লিখেছেন⸺আমাদের দলে হিন্দু-মুসলমান সবাই ছিল। হাতে হাত মিলিয়ে এই দুর্গোপূজার আয়োজন করেছিলাম। হাতে হাত মেলানোদের একজন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা খালেদা বেগম। তিনি বলেছেন, নতুন ঢাকায় বড় পরিসরে পূজার এটিই প্রথম উদ্যোগ। সেদিন হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তড়িঘড়ি করে কাজে নেমে পড়লাম। বেশিরভাগ টাকা বিভিন্ন মুসলমান বন্ধুরাই দেন। কলাবাগানের পূজার হাত ধরেই পরে বনানী মাঠ উত্তরা ও আজিমপুরের সরকারি কোয়ার্টার এবং ধানমন্ডিতে আয়োজিত হয় বিশাল পরিসরে পূজা উৎসব। এ সম্পর্কে ধানমন্ডির বাসিন্দা সম্রাট সরকার বলেছেন, এই পূজা শুরু করার সময় মুসলমান বন্ধুরাই সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছেন। আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। [প্রথম আলো, ২১.১০.২০১৪]

সম্প্রীতির এমন নজির দেখার পর এছাড়া আর কী বলার আছে⸺এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি!

প্রথমেই আমরা বলে নিই, ধর্ম যার যার উৎসব সবার⸺এই যে বুলি, আমাদের এ দেশে এটা কি আসলেই বাস্তব? আমাদের ঈদ-উৎসবে হিন্দুরাও কি শরিক হয়? ঈদগাহে, কিংবা এর আশেপাশে? বিশেষত কুরবানির ঈদে? আমাদের ঈদের জামাত, সারিবদ্ধ হয়ে সুশৃঙ্খলরূপে নামাজ আদায় করা, কুরবানির ঈদে এ নামাজের পরে পশু কুরবানি করা⸺এসব দেখার জন্যে হিন্দুরা কি মুসলমানদের মতোই উৎসবের আমেজে বেরিয়ে আসে? কুরবানির পশু জবাই করার পর দীর্ঘ সময় ধরে চলে সেগুলো খাবার-উপযোগী করার পালা। উৎসবের আমেজে সেখানেও কোনো ঘাটতি দেখা যায় না মুসলমানদের। কিন্তু জবাইয়ের সময় না হয় নাই হলো, ওই মাংস বানানোর সময় এসেও কি হিন্দুরা শুভেচ্ছা জানায় মুসলমানদের? তারা আসে না। কারণ, একে তো আমরা পূজামন্ডপে না গিয়েও যতটা উদারতা ও সম্প্রীতি দেখাতে পারি, এটা তারা পারে না।

দ্বিতীয়ত, আমাদের গরু জবাইয়ের এ উৎসবকে তারা মেনে নেবেই কী করে! গরুকে তো তারা পূজনীয় মনে করে। মুসলমানদের গরু জবাইকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে কী বর্বর কান্ডই না ঘটছে প্রতিনিয়ত! গো-হত্যার গুজবে যেখানে পিটিয়ে মারা হয় মুসলমানদের, সেখানকার প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে আহ্বান জানান গরুর যত্ন নেয়ার। যেন তাদের কাছে মানুষের চেয়ে গরুর মূল্য ও সম্মানই বেশি। সে যাই হোক, যে গরুকে তারা পূজনীয় মনে করে, মায়ের সমান বিবেচনা করে সম্মান করে, গরুর মল-মূত্রও যখন তাদের কাছে অতি পবিত্র, সেখানে গরু জবাইয়ের উৎসবে তারা শামিল হতে পারবে না⸺এটাই স্বাভাবিক।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনো গুণীজনের মুখে তখন আর বলতে শোনা যায় না⸺ধর্ম যার যার উৎসব সবার। হিন্দুরাও বলেন না, মুসলমানরাও না। তাহলে তো সোজা এমন বললেই হয়⸺পূজা হিন্দুদের, উৎসব সকলের! এরপরের কথা হলো, ধর্মকে কেন্দ্র করে যে উৎসব, ধর্মের নিয়ম মেনে যে উৎসব, ধর্মীয় বিধান পালন করার জন্যে যে উৎসব, সেখানে ধর্ম ও উৎসবকে আলাদা করার সুযোগ কোথায়?

একজন মুসলমান মূর্তিপূজার অনুষ্ঠানে যেতে পারে কিনা⸺এর সমাধান করতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে⸺মূর্তিপূজার সঙ্গে ইসলামের সম্পর্কের ধরনটা কেমন। এ সম্পর্কই আমাদের বলে দেবে পূজার অনুষ্ঠানে আমাদের যাওয়ার বৈধতা-অবৈধতার কথা। আমাদের কারও কাছেই হয়তো অজানা নয়⸺হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন, তখন মক্কায় ছিল মূর্তিপূজার সয়লাব। মূর্তি সেখানকার মুশরিকদের জীবনকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, তারা পবিত্র কাবাঘরের আশেপাশে মসজিদে হারামের ভেতরে শত শত মূর্তি স্থাপন করেছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার লোকদেরকে এ মূর্তিপূজা ছেড়ে আসারই দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাদেরকে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন শত উপাস্যের উপাসনা ছেড়ে এক মহান মালিকের উপাসনা করার।

মূর্তিবিরোধী এ দাওয়াতের কারণেই তিনি বিরাগভাজন হয়েছিলেন তাঁর আপনজনদের। নবুওয়ত প্রাপ্তির আগে মানবতা ও মানবিকতার চরম দুঃসময়েও তিনি যেখানে ছিলেন মক্কাবাসীর আস্থার পাত্র, পরম আশ্রয়, বিশ্বস্ততার অনুপম নিদর্শন, সেখানে মূর্তিপূজা ত্যাগ করার এ দাওয়াতই তাদেরকে তাঁর বিরোধী করে তোলে। তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদেরকে যতভাবে সম্ভব তারা কষ্ট দেয়। কতজনকে তো শহীদও করে দেয়! এমনকি হত্যার চক্রান্ত করে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়েও। একপর্যায়ে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে হিজরত করতে হয় মুসলমানদের। এসবই ছিল মূর্তিপূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ফিরে আসার দাওয়াতকে কেন্দ্র করেই। শত প্রলোভন আর হাজারো নির্যাতন সত্ত্বেও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবিচল ছিলেন তাওহীদ ও একত্ববাদের এ দাওয়াতের ওপর।

আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ব পুরুষ সায়্যিদুনা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। মূর্তিকে কেন্দ্র করে তিনিও আপনজনদের রোষের মুখে পড়েছিলেন। জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে তিনি নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। সেই ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে।

‘আমি তো ইতিপূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তাঁর সম্পর্কে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত। যখন সে তাঁর পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলল, ‘এ মূর্তিগুলো কী, যাদের পূজোয় তোমরা রত রয়েছ?’ তারা বলল, আমরা আমাদের পিতৃপুরুষগণকে এদের পূজা করতে দেখেছি। সে বলল, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃপুরুষগণও রয়েছে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য নিয়ে এসেছ, না তুমি কৌতুক করছ? সে বলল, না, তোমাদের প্রতিপালক তো আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, যিনি এসবকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী। শপথ আল্লাহর, তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলো সম্বন্ধে অবশ্যই কৌশল অবলম্বন করব।

অতঃপর সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল মূর্তিগুলোকে, এদের বড়টি ব্যতীত; যাতে তারা এর দিকে ফিরে আসে। তারা বলল, আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি এমন আচরণ করল কে? সে নিশ্চয়ই সীমালঙ্ঘনকারী। কেউ কেউ বলল, আমরা এক যুবককে এদের সমালোচনা করতে শুনেছি, তাকে বলা হয় ইবরাহীম। তারা বলল, তাকে লোকসম্মুখে উপস্থিত করো, যেন তারা প্রত্যক্ষ করতে পারে। তারা বলল, হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি এরূপ করেছ? সে বলল, বরং এদের এ বড়টিই তা করেছে, এদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি এরা কথা বলতে পারে! তখন তারা মনে মনে চিন্তা করে দেখল এবং একে অপরকে বলতে লাগল : তোমরাই তো সীমালঙ্ঘনকারী!

এরপর তাদের মাথা নুইয়ে গেল এবং তারা বলল, তুমি তো জানই যে, এরা কথা বলতে পারে না। ইবরাহীম বলল, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর উপাসন কর যা তোমাদের কোনো উপকার করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক তোমাদেরকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের উপাসনা কর তাদেরকে! তবুও কি তোমরা বুঝবে না? তারা বলল : তাকে জ্বালিয়ে দাও, আর তোমাদেরকে দেবতাদের সাহায্য করো, যদি কিছু করতে চাও। আমি বললাম : হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের জন্যে শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। [আম্বিয়া : ২১ : ৫১-৬৯]

এই হচ্ছে পবিত্র কুরআনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। আল্লাহ তাঁর নবী ইবরাহীমকে আগুনেও নিরাপদ রেখেছেন, আগুনকে শীতল ও নিরাপদ করে দিয়েছেন⸺এ তো পরের কথা। এর আগে তাঁর জাতির লোকেরাই তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল। অপরাধ একটাই⸺মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কথা বলা, মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। সেই নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামই আমাদের মুসলিম জাতির পিতা। পবিত্র কুরআনে তাঁর কথা বলা হয়েছে এভাবে⸺‘আবীকুম ইবরাহীম’ অর্থাৎ তোমাদের বাবা ইবরাহীম। তিনি যে ধর্মাদর্শের দিকে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একই ধর্মাদর্শের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়টি কত জায়গায় কতভাবে বর্ণিত হয়েছে! একটি আয়াত লক্ষ করুন⸺

وَ قَالُوْا كُوْنُوْا هُوْدًا اَوْ نَصٰرٰی تَهْتَدُوْا ؕ قُلْ بَلْ مِلَّةَ اِبْرٰهٖمَ حَنِیْفًا ؕ وَ مَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ

তারা (ইহুদি-খৃষ্টানরা) বলে, তোমরা ইহুদি কিংবা খৃষ্টান হয়ে যাও, তাহলে সঠিক পথ পেয়ে যাবে। তোমরা বলো, আমরা বরং ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করব, যিনি যথাযথ সরল পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। [বাকারা : ২ : ১৩৫]

এই হচ্ছে আমাদের সঙ্গে মূর্তিপূজার সম্পর্ক। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সঙ্গে মূর্তিপূজার সম্পর্ক। এছাড়াও পবিত্র কুরআনে মহান রাব্বুল আলামিন নানা জায়গায় মানুষকে মূর্তিপূজা ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মূর্তির প্রাণহীনতা ও অক্ষমতার কথা তুলে ধরেছেন। বলেছেন যারা মূর্তি পূজা করে তাদের কাছে এ নিয়ে কোনো দলিলপ্রমাণ না থাকার কথাও। বিভিন্ন যুক্তিতে তাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন মূর্তিপূজার অসারতা। উদাহরণ-উপমা দিয়েও তাদের বুঝিয়েছেন। একটি উপমা এখানে তুলে ধরছি⸺

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوْا لَهٗ ؕ اِنَّ الَّذِیْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ لَنْ یَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَّ لَوِ اجْتَمَعُوْا لَهٗ ؕ وَ اِنْ یَّسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَیْـًٔا لَّا یَسْتَنْقِذُوْهُ مِنْهُ ؕ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَ الْمَطْلُوْبُ

হে মানুষগণ! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, তা তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনো। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এমনকি এ উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্রিত হলেও নয়। এবং তাদের কাছ থেকে মাছি যদি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তারা এটাও তার কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারে না। উপাস্য আর উপাসক কতই না দুর্বল! [হাজ্জ : ২২ : ৭৩]

দুর্গার মূর্তিকে পূজা করার অনুষ্ঠানে তাই কোনো মুসলমান যেতে পারে না। মূর্তি পূজা করার জন্যে আয়োজনে সহযোগিতা করতে পারে না। এটা উদারতার বিষয় নয়, এখানে জড়িত বিশ্বাসের প্রশ্ন। মুসলমানের চিন্তা ও বিশ্বাস তো হতে হবে মূর্তিবিরোধী, একত্ববাদী। তাই সে যদি মূর্তিপূজার উৎসবে শরিক হয়, তাহলে তাকে তার মূর্তিবিরোধী বিশ্বাসকে বিসর্জন দিয়েই যেতে হবে। নিজের আত্মমর্যাদাবোধ, নিজের ধর্মের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়েই যেতে হবে। তা যদি না হয়, তাহলে মূর্তিবিরোধী চিন্তা লালন করে, মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ইসলামের অনুসারী হয়ে সে আবার মূর্তিপূজার অনুষ্ঠানে যায় কী করে! এরপরও কি বলা যাবে, আত্মমর্যাদাবোধ বলতে তার কিছু আছে?

যারা একটু বেশি উদার হয়ে যুক্তি দিতে চায়⸺আমরা তো আর পূজা করছি না, কেবল তাদের সঙ্গে তাদের আনন্দে শরিক হচ্ছি, তাদের অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে তাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, তারা পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে নিজেদের পথের সন্ধান পেতে পারে⸺

وَ قَدْ نَزَّلَ عَلَیْكُمْ فِی الْكِتٰبِ اَنْ اِذَا سَمِعْتُمْ اٰیٰتِ اللّٰهِ یُكْفَرُ بِهَا وَ یُسْتَهْزَاُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوْا مَعَهُمْ حَتّٰی یَخُوْضُوْا فِیْ حَدِیْثٍ غَیْرِهٖۤ ۖ ؗ اِنَّكُمْ اِذًا مِّثْلُهُمْ

কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে⸺আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করা হচ্ছে, তা নিয়ে বিদ্রুপ করা হচ্ছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে, ততক্ষণ তোমরা তাদের সঙ্গে বসো না, অন্যথায় তোমরাও তাদের মতোই হবে। [নিসা : ৪ : ১৪০]

মূর্তিপূজার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার আয়াতসমূহকে, তাঁর নির্দেশনা ও বাণীসমূহকে কার্যত কীভাবে যে অস্বীকার করা হয়⸺তা তো সচেতন কারও কাছেই অস্পষ্ট থাকার কথা নয়।

ধর্ম যার যার, উৎসব কি সবার?

আমরা কথা বলছিলাম ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ নিয়ে। আসলে ধর্মীয় উৎসবে যে ধর্ম আর উৎসবকে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করা যায় না, এটা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস থেকেই বুঝতে পারি। আমাদের যে ঈদ-উৎসব, এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন :

إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيدًا وَهَذَا عِيدُنَا

প্রত্যেক জাতিরই উৎসব রয়েছে, আর এটা আমাদের উৎসব। [সহীহ বুখারী, হাদীস : ৯৫২]

ইসলামের আগমনের পূর্বে তৎকালীন আরবে কয়েকটি উৎসব প্রচলিত ছিল। সাহাবায়ে কেরাম সেগুলো পালন করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেন এবং সে প্রেক্ষিতেই আমাদের স্বতন্ত্র উৎসব হিসেবে দুটি ঈদকে নির্ধারণ করা হয়। মানুষের মন স্বাভাবিকভাবে উৎসবমুখী। যে কোনো উৎসবেই সে পুলক অনুভব করে। শরিক হতে চায়। মানব-মনের এ স্বাভাবিক চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখেই ইসলামে দুটি ঈদের বিধান রয়েছে। তাই অন্য কোনো জাতির কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমাদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। আর সে অনুষ্ঠান যদি হয় ইসলামের আজন্ম শত্রু মূর্তিপূজার, তাহলে তো বলাই বাহুল্য।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণায় কোনো অস্পষ্টতা নেই⸺

وَ مَنْ یَّبْتَغِ غَیْرَ الْاِسْلَامِ دِیْنًا فَلَنْ یُّقْبَلَ مِنْهُ ۚ وَ هُوَ فِی الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ

কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দীন অবলম্বন করতে চাইলে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। [আলে ইমরান : ৩ : ৮৫]

একবারের ঘটনা। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন হাতে তাওরাতের কয়েকটি পৃষ্ঠা সঙ্গে করে। তিনি এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কুরায়যা গোত্রের আমার এক ভাইয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সে আমাকে তাওরাতের কিছু কথা লিখে দেয়। আমি এগুলো আপনাকে পড়ে শোনাই? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা তখন বিবর্ণ হয়ে গেল। পাশে থাকা আবদুল্লাহ ইবনে সাবেত রা. নামের এক সাহাবী তাকে বললেন, আল্লাহ তোমার বিবেকবুদ্ধি সব নিয়ে গেলেন নাকি? তুমি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার প্রতি লক্ষ করছ না? তখন হযরত উমর রা. বলে উঠলেন : আল্লাহ আমার প্রভু, ইসলাম আমার ধর্ম, আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নবী⸺এতেই আমি সন্তুষ্ট। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা স্বাভাবিক হলো। তিনি তাকে বললেন : যদি মূসাও তোমাদের মাঝে নেমে আসতেন আর তোমরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে তার অনুসরণ করতে, তবুও তোমরা পথহারা হয়ে পড়তে। তোমরাই হলে আমার উম্মত, আর আমিই তোমাদের নবী। [মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ১০১৬৪]

তাই নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচিত করে, মুসলিম নাম ধারণ করে ইসলামের স্বাতন্ত্র মুছে দেয়ার অবকাশ নেই। সম্প্রীতির নামে অন্য ধর্মের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে একাত্ম হওয়ার সুযোগ নেই। কেউ যদি একে গোঁড়ামি বলতে চান, বলতে পারেন। কিন্তু কথা এই একটাই⸺ইসলামের একজন অনুসারী এসব কাজ করতে পারে না। আর আসলে এটা কোনো গোঁড়ামিও নয়। একে বরং বলা যায় আত্মসম্মানবোধ। যে মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে করে ইসলাম ছড়িয়েছে দিকে দিকে, যে মূর্তির পূজকেরা ইসলামের কণ্ঠ চেপে ধরে শ্বাসরোধে হত্যা করতে চেয়েছে সেই শুরুর যুগেই, নিজেকে ইসলামের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে কোন মুখে আবার তাদের ধর্মীয় উৎসবে যোগদান? ইসলামের অনুসারী হতে হলে ইসলামের মান-মর্যাদাকে খাটো করার কোনো অবকাশ নেই।

আর ইসলাম যে সম্প্রীতি আমাদের শিখিয়েছে, তা আমরা বুক টান করেই বলতে পারি⸺সম্প্রীতির এ শিক্ষা অন্য কোনো ধর্মেই নেই। কুরআনের সরল ঘোষণা⸺ধর্ম নিয়ে কোনো জোরজবরদস্তি নেই। [বাকারা : ২ : ২৫৬] প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করবে। কোনো রাষ্ট্রে যদি ইসলামি বিধান চালু থাকে, সেখানকার সব নাগরিককেই যে মুসলমান হতে হবে⸺এমন কোনো কথা নেই। একটি ইসলামি রাষ্ট্রে যে কোনো ধর্মের নাগরিকই থাকতে পারে। তারা পারস্পরিক সম্প্রীতির সঙ্গেই থাকবে, পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার সঙ্গে থাকবে। প্রয়োজন হলে রাষ্ট্র তাদের সহযোগিতাও করবে। কিন্তু তাই বলে আবার নিজেদের ধর্মীয় স্বকীয়তা বিসর্জন দেয়া যাবে না। ভুলে যাওয়া যাবে না নিজেদের বিশ্বাসের কথা। ইসলামের অনুসারী হিসেবে টিকে থাকতে চাইলে এর বিকল্প নেই।

Comments
  1. কথাগুলো একদম সঠিক।
    এই বিষয়টি নিয়ে একটি ভিডিও বানিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দিতে পারলে ভালো হতো।
    আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সহিহ্ বুঝ দিন।
    -আমীন।

  2. আপনি সঠিক বলেছেন।
    ভিডিও আকারে ফেইচবুক, ও ইউটিউবে আলচনাটুকু ছড়িয়ে দিন।

  3. جزاك الله خيرا.

  4. এ বিষয়গুলো আমরা সবাই কমবেশি জানি এত কিছু জানার পরেও আমরা গুরুত্ব দেই না বিধর্মীদের এই উৎসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলি এই তাল মিলি না চলার জন্য আমাদের ব্রেনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে কিভাবে এই উৎসব থেকে আমরা দূরে থাকতে পারি,

  5. পূজার সময় তৈরি নাড়ু খাওয়া যাবে কি

    1. পূজা উপলক্ষে হিন্দুরা যেসব খাবার তৈরি করে, কিছু শর্তসাপেক্ষে সেগুলো খাওয়া জায়েজ হতে পারে। যেমন, এক. সেসব খাবারে হারামের কোনো মিশ্রণ থাকতে পারবে না। দুই. প্রসাদ অর্থাৎ মূর্তি বা দেবতার জন্যে উৎসর্গিত হতে পারবে না। তিন. তাদের পূজার অনুষ্ঠানে শরিক হওয়া যাবে না।
      এসব শর্ত যদি পাওয়া যায়, যদি সে খাবার মৌলিকভাবে হালাল হয় এবং তা প্রসাদজাতীয় কিছু না হয়, আর কোনো হিন্দুর পক্ষ থেকে যদি কোনো মুসলমানকে সে খাবার খেতে দেয়া হয়, তবে তা খাওয়া জায়েজ হবে। অবশ্য যদি সুযোগ থাকে, তবে পূজাকেন্দ্রিক কোনো খাবার গ্রহণ না করাটাই ভালো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
ক্যাটাগরি সমূহ
ট্যাগ সমূহ
error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ