Post Updated at 13 Jul, 2023 – 6:34 PM

কুরবানির ফজিলত

কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব আমল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

 

مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ، وَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا

সামর্থ্য থাকার পরও যে কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগায় না আসে।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩১২৩; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭৫৬৫]

কুরবানি কার ওপর ওয়াজিব

প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে কুরবানির দিনগুলোতে (১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত) প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকবে তার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব।

কুরবানির নেসাবের হিসাব

টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও প্রয়োজন-অতিরিক্ত সকল আসবাবপত্র কুরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
আর নেসাব হচ্ছে স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন ভরি আর টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নেসাব হচ্ছে—এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। তবে যদি কারও সোনা-রূপা বা টাকা-পয়সা কোনোটিই পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু যেগুলো আছে তার সবটা মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার মূল্যের সমান হয়ে যায়, তাহলে তার ওপরও কুরবানি করা ওয়াজিব।

কুরবানির জন্যে কি পূর্ণ বছর নেসাবের মালিক থাকতে হবে?

কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্যে পূর্ণ বছর নেসাবের মালিক থাকা জরুরি নয়। বরং কুরবানির দিনগুলোতে যে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকবে, এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্তেও যদি কেউ নেসাবের মালিক হয়, তাহলেও কুরবানি ওয়াজিব হবে।

কুরবানি ওয়াজিব নয় এমন কেউ যদি পশু কেনে

যে ব্যক্তি উপরোক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয় তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। তবে সে যদি কুরবানির নিয়তে কোনো পশু কেনে, তাহলে সেই পশুটি কুরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়।

কুরবানির সময়

* মোট তিনদিন কুরবানি করা যায়—ঈদের দিন, এর পরের দিন এবং এর পরবর্তী দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে জিলহজের ১০ তারিখেই কুরবানি করা উত্তম।
* প্রত্যেক মহল্লার ঈদের নামাজের পর থেকে কুরবানির সময় শুরু হয়। অর্থাৎ নিজ মহল্লার ঈদের নামাজের পূর্বে কুরবানি করা যাবে না। অবশ্য যদি বৃষ্টি-বাদলের কারণে ১০ জিলহজ ঈদের নামাজ পড়া সম্ভব না হয়, তাহলে নামাজের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর (অর্থাৎ সূর্য ঢলে পড়ার পর) কুরবানি করা যাবে। যে মহল্লায় একাধিক ঈদের নামাজ হয়, সেখানে প্রথম ঈদের দিন প্রথম জামাতের পর থেকেই কুরবানি করা যাবে। কুরবানি আদায়কারী যদি তখনো ঈদের নামাজ না পরে থাকেন তাহলে হয়ে যাবে। কুরবানি সহীহ হওয়ার জন্যে কুরবানিদাতার ঈদের নামাজ জরুরি নয়।
* যার ওপর কুরবানি ওয়াজিব সে যদি কুরবানির নির্ধারিত দিনগুলোতে কুরবানি করতে না পারে, তাহলে কুরবানির পশু না কিনে থাকলে কুরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করতে হবে। আর যদি কুরবানির উদ্দেশ্যে পশু কেনা থাকে, তাহলে সেই পশু জীবিত সদকা করতে হবে।

কুরবানির পশু

* উট গরু মহিষ ছাগল ভেড়া দুম্বা—এ ছয় ধরনের গৃহপালিত পশু দিয়ে কুরবানি করা জায়েজ। নর-মাদী যেটাই হোক, খাসি করা হোক কিংবা না হোক, কুরবানি করা যাবে।

* উল্লিখিত পশুগুলো ব্যতীত অন্য কোনো পশু দিয়ে কুরবানি জায়েজ নয়। যেমন, বন্য গরু, হরিণ, খরগোশ, মোরগ ইত্যাদি। যে পশু খোড়া অর্থাৎ তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না, যে পশু এমন দুর্বল যে জবাইয়ের স্থানে হেঁটে যেতে পারে না, যে পশুর একটি দাঁতও নেই কিংবা এত দাঁত পড়ে গেছে যে তা কোনো ঘাস বা খাবার চিবাতে পারে না, যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ কিংবা একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট—এসব পশু দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে না। যদি কোনো পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে যায়, যার ফলে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে, তাহলে তা দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে না। তবে যদি পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু অংশ ফেটে বা ভেঙ্গে যায় কিংবা শিং একেবারেই না ওঠে, তাহলে তা দিয়ে কুরবানি করা জায়েজ। যদি কোনো পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তার বেশি কাটা থাকে, তাহলে তা দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে না। লেজ বা কান যদি অর্ধেকের বেশি থাকে, তাহলে কুরবানি জায়েজ হবে। তবে হৃষ্টপুষ্ট পশু কুরবানি করা উত্তম।

কুরবানির পশুর বয়স

কুরবানির জন্যে উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের, গরু-মহিষ দুই বছরের এবং ছাগল ভেড়া ও দুম্বা এক বছরের হতে হবে। তবে কোনো ভেড়া ও দুম্বার বয়স যদি এক বছরের চেয়ে কিছু কম ও ছয় মাসের চেয়ে বেশি হয়, কিন্তু দেখতে এক বছরের ভেড়া বা দুম্বার মতোই হৃষ্টপুষ্ট মনে হয়, তাহলে তা দিয়েও কুরবানি করা যাবে। কিন্তু ছাগলের বয়স এক বছরের কম হলে তা দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে না।

পশুর বয়সের ক্ষেত্রে কার কথা গ্রহণযোগ্য

পশুর বয়সের ক্ষেত্রে বিক্রেতার কথাই গ্রহণযোগ্য; নির্দিষ্ট সংখ্যক দাঁত ওঠা কোনো জরুরি বিষয় নয়।

কুরবানির শরিকসংখ্যা

উট গরু মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন মিলে কুরবানি করতে পারে। এর কম হলেও কোনো সমস্যা নেই। তবে প্রত্যেককেই কমপক্ষে সাত ভাগের এক ভাগের শরিক হতে হবে। শরিকের সংখ্যা বেজোড় হওয়া জরুরি নয়। আর ছাগল ভেড়া ও দুম্বার একটি দিয়ে একজনই কুরবানি করতে পারবে। উট গরু মহিষে যদি সাত শরিকের বেশি হয় কিংবা ছাগল ভেড়া ও দুম্বায় একাধিক শরিক থাকে, তাহলে কারও কুরবানিই হবে না।

কুরবানির পশুতে আকিকা

উট গরু মহিষে কেউ আকিকার নিয়তেও শরিক হতে পারে। এতে কুরবানি ও আকিকা দুটিই সহীহ হয়ে যাবে।

হারাম উপার্জনকারীর সাথে কুরবানি

শরিকদের কারও টাকা যদি হারাম হয়, কিংবা কোনো শরিক যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানি করে, তাহলে কারও কুরবানিই সহীহ হবে না।

শরিকে কুরবানি করলে গোশত কীভাবে বণ্টন করতে হবে

শরিকে কুরবানি করলে গোশত ওজন করে সমান হারে বণ্টন করতে হবে।

গর্ভবতী কুরবানির পশুর বাচ্চা

কুরবানির পশু যদি গর্ভবতী হয় আর জবাইয়ের পর বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে। চাইলে সে গোশত খেতেও পারবে। প্রসবের সময় আসন্ন হলে জবাই করা মাকরুহ। আর জবাইয়ের আগে বাচ্চা প্রসব করলে সে বাচ্চা জীবিত সদকা করে দেবে কিংবা জবাই করে গোশত সদকা করবে।

জবাইয়ের মাসায়েল

* সম্ভব হলে নিজের কুরবানির পশু নিজে জবাই করা উত্তম।
* জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি অংশ নিলে প্রত্যেককেই জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলতে হবে।
* যাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করা হচ্ছে, জবাইয়ের আগে তাদের নাম পড়া জরুরি নয়।
* জবাইয়ের পর পশু পূর্ণ নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরুহ।
* জবাইয়ের আগে ছুরি ভালোভাবে ধার করে নেবে। জবাইয়ের সময় পশু যেন অতিরিক্ত কষ্ট না পায়। এক পশুকে আরেক পশুর সামনেও জবাই করবে না।
* জবাইয়ের আগে কুরবানির দোয়াটি পড়া সুন্নত। না পারলে শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলেও জায়েজ হবে। তবে ইচ্ছাকরে এতটুকুও যদি কেউ না বলে তাহলে জায়েজ হবে না।

কুরবানির পশু দিয়ে কোনোরূপ উপকৃত হলে

কুরবানির পশু দিয়ে হালচাষ করা, তাতে আরোহণ করা, পশম কাটা, দুধ পান করা জায়েজ নয়। কেউ করে থাকলে এর মূল্য সদকা করতে হবে। আর দুধ দোহন না করলে যদি পশুর কষ্ট না হয় তাহলে দোহন করবে না। তবে কেউ করে ফেললে সে দুধ সদকা করে দিতে হবে।

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা জায়েজ। যদি সে অসিয়ত করে যায় এবং তার টাকা দিয়েই কুরবানি করা হয় তাহলে এর গোশত গরীবদের সদকা করে দেবে। আর যদি ওয়ারিশ বা অন্য কেউ নিজের টাকায় মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করে, তাহলে সে গোশত নিজেও খেতে পারবে, অন্যকেও খাওয়াতে পারবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানি

সামর্থ্য থাকলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানি করা উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রা.কে তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানি করার ওসিয়ত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানি করতেন।

কুরবানির গোশত কাদেরকে দেবে? সংরক্ষণ করা যাবে কি?

কুরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরীবদেরকে, আরেকভাগ আত্মীয় ও পড়শিদেরকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশতও নিজে রেখে দিতে পারবে। যতদিন ইচ্ছা, তা সংরক্ষণও করা যাবে।

চামড়া বা গোশত দিয়ে পারিশ্রমিক

চামড়া গোশত বা কুরবানির পশুর অন্য কোনো কিছু কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসেবে গোশত দিতে বা খাওয়াতে কোনো সমস্যা নেই।

চামড়া কী করবেন?

কুরবানির চামড়া মালিক ইচ্ছা করলে নিজে ব্যবহার করতে পারবে কিংবা কাউকে দিয়েও দিতে পারবে। তবে বিক্রি করলে এর মূল্য অবশ্যই গরীবদেরকে সদকা করতে হবে।

ঈদের দিনের মোরগ জবাই করা

ঈদুল আযহার দিনও মোরগ জবাই করতে কোনো সমস্যা নেই। তবে কুরবানির নিয়তে মোরগ জবাই করা যাবে না।

কুরবানির গোশত দিয়ে খানা শুরু করা

ঈদুল আযহার দিন কুরবানির গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত।

 

 

 

 

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
ক্যাটাগরি সমূহ
ট্যাগ সমূহ
error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ