Post Updated at 30 Apr, 2023 – 11:13 AM

‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার মজুরি দিয়ে দাও।’[সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৪৪৩] ‘যে গোলাম আল্লাহ তায়ালার হক আদায় করে এবং তার মনিবের হকও আদায় করে তার জন্যে রয়েছে দুইটি প্রতিদান।’ [সহীহ বুখারী, হাদীস : ২৫৪৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৬৬৬]

উল্লিখিত দুইটি বাক্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ নিঃসৃত দুইটি হাদীসের বাংলা অনুবাদ। ইসলামি সমাজব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিকের মাঝে যে সম্প্রীতি সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতা বিরাজ করে, এই হাদীস দুটি তার ভিত্তিস্বরূপ। একটিতে রয়েছে মালিকের প্রতি নির্দেশনা, আরেকটিতে যথাযথ দায়িত্বপালনে শ্রমিককে উৎসাহিত করা হয়েছে। মালিককে বলা হয়েছে, শ্রমিক যখন তোমার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করে শেষ করবে, তখন তুমিও তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ দায়িত্বটুকু আদায় করে দাও। তার পাওনা তাকে বুঝিয়ে দাও। তাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। তাকে এজন্যে ঘুরাবে না। অনর্থক সময়ক্ষেপন করে টালবাহানা করবে না। বরং যত দ্রুত সম্ভব তার পাওনা তাকে পরিশোধ করে দাও। কাজ শেষ করার পর এত দ্রুত তার পাওনা দিয়ে দাও, যেন পারিশ্রমিকের টাকা হাতে পাওয়ার পূর্বে তার শরীরের ঘামও শুকাতে না পারে। এখানে কাজ শেষ করার পর শ্রমিকের মজুরি আদায়ের ক্ষেত্রে মালিকের আচরণ কেমন হবে তার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কাজ শুরু করার পর থেকে শেষ করা পর্যন্ত তার সঙ্গে মালিক কেমন আচরণ করবে, এ হাদীস থেকে তাও স্পষ্ট হয়ে যায়।

 

অপরদিকে ইসলাম শ্রমিককে বলেছে, সে যেন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথরূপে পালন করে। কাজ কম করার জন্যে যেন কোনো ফাঁক-ফোকর তালাশ না করে। মালিক দেখুক কিংবা না দেখুক, সে যেন তার চুক্তিবদ্ধ দায়িত্বপালনে কোনোরূপ অবহেলার শিকার না হয়। উপরোক্ত হাদীসে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে মালিকের হক যথাযথভাবে আদায়কারী গোলামের মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।

শুধু উক্ত দুটি হাদীসই নয়, বরং হাদীসের গ্রন্থাবলিতে মালিক ও শ্রমিকের প্রতি নির্দেশনাসম্বলিত এ ধরনের আরও অনেক হাদীস রয়েছে । যে কোনো সমাজের জন্যেই দুটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ মালিক ও শ্রমিক। মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকেই মানুষের মাঝে ধনী-গরিব সচ্ছল-অসচ্ছল মালিক-শ্রমিকের একটি রেখা এঁকে দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে তিনি সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন—আমিই পার্থিব জীবনে তাদের মাঝে তাদের জীবিকা বণ্টন করি এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। [সুরা যুখরুফ, আয়াত : ৩২] পারস্পরিক যে নির্ভরশীলতার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে মানবসমাজ, সে নির্ভরশীলতা টিকে থাকার অপরিহার্য মাধ্যম এই ব্যবধান। এ ব্যবধানের কারণেই প্রয়োজনের তাগিদে গরিব-অসচ্ছল ব্যক্তি যেমন ধনীদের কাছে যায়, তেমনি ধনী ও সচ্ছল যারা, তারাও গরিব অসচ্ছল ব্যক্তিদের খোঁজে বের হয়। সমাজ টিকে থাকার জন্যে শ্রমিক-মালিকের এই ব্যবধান ও সহাবস্থান অনস্বীকার্য। যদি কোথাও এ ব্যবধানরেখা মুছে যায়, যদি কোনো সমাজে শ্রমিকের কোনো অস্তিত্ব না থাকে, বরং সকলেই মালিকপক্ষ হয়ে যায়, কিংবা কোথাও যদি শ্রমিককে কাজে নিয়োজিত করার মতো কোনো মালিক না থাকে, তাহলে সেখানে কি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন সম্ভব হবে? মালিককেই যদি শ্রমিকের কাজ করতে হয় তাহলে কেমন হবে? বাধ্য হয়েই তখন তাদেরকে অন্য কোথাও থেকে হলেও শ্রমজীবী মানুষদেরকে নিয়ে এসে উক্ত ব্যবধানটি সৃষ্টি করতে হবে।

যেহেতু এই উভয় শ্রেণির অস্তিত্বের ওপরই সমাজের অস্তিত্ব নির্ভর করে, তাই ইসলাম উভয়েরই কল্যাণ বিবেচনা করেছে। কোথাও আদেশের সুরে, কোথাওবা উপদেশের সুরে উভয়ের জন্যেই ইসলামের নির্দেশনা—যেন সবাই অন্যের হক আদায়ে যতœবান হয়। অন্যের কল্যাণ কামনা করে। এই কল্যাণকামিতার নামই ইসলাম। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, দীন হচ্ছে কল্যাণকামিতা। [সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৯৫] তাই কেউ শ্রমিক হোক কিংবা মালিক হোক, একে অন্যের মঙ্গল ও কল্যাণের দিকে লক্ষ রাখবে অবশ্যই। এই হচ্ছে ইসলামের আদর্শ।

বাহ্যত মালিক পক্ষ ও সচ্ছল শ্রেণির প্রতি শ্রমিক ও অসচ্ছল লোকেরা একটু বেশি নির্ভরশীল। নিজেদের জীবিকার তালাশে কাজের খোঁজে তাদের ঘুরে ফিরতে হয় ধনীদের দুয়ারে দুয়ারে। ধনীদের অধীনে কাজ করে শ্রম খাটিয়ে তারা উপার্জন করে নিজেদের জীবিকা। এ বাহ্যিক দিকে চোখ রেখে ধনী ব্যক্তিরাও মনে করতে পারে—এই অসচ্ছল শ্রেণি তো আমাদের কাজকর্ম করেই নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। ইসলামের অমর নির্দেশনায় এই বাহ্যিক দিকটিও সযতেœ লক্ষ রাখা হয়েছে—তারা তোমার ভাই, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। আল্লাহ যদি কারও ভাইকে তার অধীন করে দেন, তাহলে সে নিজে যা আহার করে, তার ভাইকেও যেন তা থেকেই আহার করায়। সে নিজে যে কাপড় পরে, তাকেও যেন তা থেকেই পরতে দেয়। সাধ্যাতীত কোনো কঠিন কাজের বোঝা যেন সে তার ওপর চাপিয়ে না দেয়। আর যদি কোনো কঠিন কাজ করতে দেয়, তাহলে যেন তাকে সে কাজে সহযোগিতা করে। [সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০৫০]

এই হচ্ছে ইসলাম। এখানে শ্রমিক-মালিকের ব্যবধানকে অস্বীকার করা হয় নি। আবার শ্রমিককে অধীনস্ত মনে করে অন্যায়ভাবে তার ওপর কঠিন কঠিন সব কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। যে রক্ত-মাংসে গড়া একজন মালিকের দেহ, ঠিক সেই একই রক্ত-মাংসে গড়া একজন শ্রমিকের দেহও। মানুষ হিসেবে একজন মালিকের যতরকম চাহিদা রয়েছে, ঠিক একজন শ্রমিকেরও সেসব চাহিদা রয়েছে। তাই হাদীসে বলা হয়েছে, ‘তারা তোমাদের মতোই মানুষ। তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কেবল তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই বলে তাদের শারীরিক ও মানসিক চাহিদাগুলো রহিত হয়ে যায় নি। নিজেরা তোমরা যে খাবার খাবে, তাদেরকেও তা থেকে খাওয়াবে, নিজেরা যে কাপড় পরবে, তাদেরকেও তা পরাবে।’

শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের জন্যে এই হচ্ছে ইসলামের নির্দেশনা। এখানে শ্রমিক সর্বাত্মকভাবে তার মালিকের কল্যাণ কামনা করবে। কৃতজ্ঞচিত্তে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেবে। বিশ্বস্ত মনে করে মালিক তার হাতে যা কিছু অর্পণ করে, সেসব সম্পদ যথাযথ সংরক্ষণ করবে। মালিকও শ্রমিকের সঙ্গে সকৃতজ্ঞ আচরণ করবে। তার সঙ্গে আচরণ যেন হয় সহযোগিতামূলক, প্রতিপক্ষমূলক নয়। তাকে মনে রাখতে হবে, শ্রমিক যেমন জীবিকার জন্যে মালিকের মুখাপেক্ষী, তেমনি মালিকও তার সম্পদ টিকিয়ে রাখতে শ্রমিকের মুখাপেক্ষী। উভয়ের পক্ষ থেকেই যদি এ সহযোগিতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক প্রকাশিত হয়, তাহলে শ্রমিক কখনোই শোষণের শিকার হবে না। মালিকপক্ষকেও তখন শ্রমিকরা তাদের প্রতিপক্ষ বিবেচনা করবে না।

আমরা যদি ইসলামি শাসনের স্বর্ণালী অতীতের দিকে ফিরে তাকাই, দেখব—সেখানে শ্রমিক আন্দোলন বলে কোনো আন্দোলন ছিল না। সে সমাজে জীবনযাত্রা নির্বাহের ক্ষেত্রে হয়তো শ্রমিক-মালিকে ব্যবধান ছিল, কিন্তু মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে তাদের মাঝে কোনো ব্যবধান ছিল না। শ্রমিকদেরকে শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা—এ রেওয়াজ তখন ছিল না। ফলে শ্রমিকদেরও প্রয়োজন হয় নি মালিকদের বিরুদ্ধে, সমাজের ধনী লোকদের বিরুদ্ধে কোনো দাবি তোলার, কোনো বিক্ষোভের ডাক দেয়ার।

শুনতে তিক্ত হলেও সত্য, আধুনিক কালের উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতির শ্রমিক-শোষণ নীতিই চলমান শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস থেকেই তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়। বর্তমানে পুরো পৃথিবীজুড়ে মে মাসের প্রথম দিনে যে শ্রমিক দিবস পালিত হচ্ছে, তার প্রচলন মাত্র সোয়াশ বছর পূর্বে শুরু হয়। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগোতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছিল আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে। সে দাবিকে স্তিমিত করে দিতে পুলিশ তখন গুলি চালিয়েছিল। এতে আন্দোলনকারী শ্রমিকরা হতাহত হয়। এই হচ্ছে শ্রমিক দিবসের ইতিহাস।

আমরা যদি আরেকটু পেছনে ফিরে যাই দেখব—পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার বুর্জোয়া সমাজ শ্রমিকদেরকে মানুষ হিসেবেই মানতে চাইত না। অষ্টাদশ শতকের শিল্পবিপ্লবের পর থেকে এ মানসিকতা প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা শ্রমিকদেরকে কেবল নিজেদের পণ্য উৎপাদনের হাতিয়ার বিবেচনা করত। ফলে যে শ্রমিকদের রক্ত-ঘাম ঝড়া শ্রমে তারা অর্থবিত্তের সৌধ নির্মাণ করে চলেছিল, সে শ্রমিকদের খেয়ে-পরে ন্যূনতম বেঁচে থাকার সুবিধাটুকু দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল না। এমনকি যদি কখনো উৎপাদন বেশি হয়ে যেত, তাহলে দাম পড়ে যাওয়ার আশংকায় তারা চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য নষ্ট করে দিত। হাজার পণ্যের সম্ভার নষ্ট করে হলেও যেন তাদের লাভের হিসেবে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। লাখো ক্ষুধার্ত অসহায় হাহাকার করতে থাকলেও এতে তাদের কিছু যায় আসে না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি—ব্রাজিলে একবার ফলন বেশি হলে আতঙ্কিত মনে পুঁজিপতিরা পরামর্শে বসে, ‘কী করা যায়?’ উদ্বৃত্ত ফসল এত বেশি যে তা মাটিতে পুঁতে রাখার মতো জায়গা নেই। পানিতে ফেলে দিলে জলজ সম্পদ—মাছের ক্ষতি হতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত হলো—সেগুলো পুড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু বিশাল সবুজ শ্যামল শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দেয়াও তো সহজ ছিল না। তবু পেট্রোল ধরিয়ে সব ছাই করে দেয়া হলো। এতে তেল ব্যয় হয়েছিল প্রায় দুই লাখ পাউন্ড। [ওহংরফব খধঃরহ অসবৎরপধ’র সূত্রে ইসলামে শ্রমিকের অধিকার] সেই ধনিক শ্রেণির লক্ষ্যই ছিল—কিছুতেই যেন শ্রমিকরা স্বাবলম্বী হতে না পারে। এ লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে তারা যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করত, তেমনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করত শ্রমিকদের দারিদ্র ও অসহায়ত্বকে স্থায়ী করে রাখতে। এটাই ছিল তাদের দর্শন। ম্যানডেভিলের ভাষায়—‘গরিবদের থেকে কাজ নেয়ার একটি মাত্র পথ, আর তা হলো এদেরকে দরিদ্র থাকতে দাও। এদেরকে পরনির্ভরশীল করে তোলো। এদের প্রয়োজন খুব অল্প করেই পূরণ করা দরকার। আপন প্রয়োজন পূরণে এদেরকে স্বাবলম্বী করে তোলা চরম বোকামী।’ [ঋধনষব ড়ভ ঃযব নববং ’র সূত্রে ইসলামে শ্রমিকের অধিকার] এই জিঘাংসু পুঁজিবাদী দর্শনের কবলে পড়ে মানবতা যখন হাহাকার করে উঠল, যখন অসহায় শ্রমিকদের সকল ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, তখন তারা আন্দোলনমুখী হলো। ধীরে ধীরে তাদের সে আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আন্দোলন আর বিক্ষোভের ভেতর দিয়ে এই অসহায় শ্রমিক সমাজ তাদের কিছু দাবিও হয়তো আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আন্দোলন এগিয়ে চলে। দেশে দেশে শ্রমিকদের ইউনিটি গড়ে ওঠে। লেবার পার্টিও হয়। বৃটেনে এই লেবার পার্টি সরকারও গঠন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এরপরও কি বর্তমান পৃথিবীতে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে? আহার-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা আর চিকিৎসার মতো মৌলিক মানবাধিকারগুলো তারা ভোগ করতে পারছে? না, পারে নি। এখনো শ্রমিক তার অধিকার পায় না। শ্রমিক-আন্দোলনের প্রায় দেড়শ বছর পরও তারা অধিকারহারা জীবন যাপন করে। তাই তো দেখা যায়, প্রতিবছরই শ্রমিক দিবসের আয়োজনে শুধু তাদের মৌলিক মানবাধিকারের দাবিই অনুরণিত হয়। বরং এখনকার নিষ্ঠুর বাস্তবতা তো এমন—যারা শ্রমিক দিবসে অধিকারের দাবিতে মুখিয়ে তোলে সভা-সমাবেশ, তারা নিজেরাই শ্রমিকদের অধিকার হরণে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সারা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ধনী-গরিব শ্রমিক-মালিক সবার ভোটের মান সমান। কিন্তু মানুষ হিসেবে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোও যদি না পায় সমাজের অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী, তাহলে ভোটের অধিকারের সুফল তারা কতটুকু ভোগ করতে পারবে?

পুঁজিবাদী এই নিষ্ঠুরতা থেকে শ্রমিকদেরকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে আরেক অর্থব্যবস্থা—সমাজতন্ত্র। এর মূলকথা ছিল—‘সমাজে অর্থনৈতিক বা সামাজিক বৈষম্য থাকবে না। শোষক পুুঁজিপতি থাকবে না। বরং প্রত্যেকেরই যোগ্যতানুযায়ী কাজ নেয়া হবে এবং প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণ দেয়া হবে।’ কার্ল মার্কসের এই দর্শনকে অনেকটা এড়িয়ে গিয়ে হলেও প্রথম বাস্তবে রূপদান করেন তার চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত সমাজতন্ত্রীদের প্রথম বিপ্লবী নায়ক অর্থনীতিবিদ ভি আই লেনিন। রাশিয়ায় তিনি সমাজতান্ত্রিক শাসন কায়েম করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে শোষণ ও বৈষম্যের অক্টোপাস থেকে অসহায় শ্রমিকদেরকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সেই রাষ্ট্রের শ্রমিকরা উল্টো আরও বেশি শোষণের শিকার হতে থাকে। মানবতা সেখানে আরও অসহায় হয়ে পড়ে। কিছুদিনের ব্যবধানে সেখানেও পুঁজিবাদের মতো যোগ্যতা অনুসারে মজুরির প্রথা চালু হয়। অসহায় মানবতাকে আজাদ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় খোদায়ী আলোক-বিবর্জিত এই নতুন দর্শন।

পৃথিবীজুড়ে এখনো পুঁজিবাদেরই রাজত্ব। ফলে সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ। শিল্পমালিক মনে করে—শ্রমিক তার প্রতিপক্ষ এবং তার বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফার ভাগ ছিনিয়ে নিতে সে ওৎ পেতে আছে। আর শ্রমিক ভাবে—তার গায়ের সমস্ত রক্ত চুষে নিয়ে এই শিল্পপতি তার ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়িয়ে তুলছে। এ তো ডাক-লুটেরা! একে খতম করতে হবে। যেন যুদ্ধের ময়দানের পক্ষ-প্রতিপক্ষ। এই আন্তরিকতামুক্ত বিরোধপূর্ণ মনোভাবের কারণেই কারখানার শ্রমিকরাই কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। সুযোগ পেলেই ভাংচুর করে। আর পত্রিকার পাতায় ছাপা হয় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কারখানা-মালিকের করুণ কান্নার ছবি।

শুধু শ্লোগান নয়, সভা-সমাবেশ আর র‌্যালি নয়, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধনিক শ্রেণির শোষণমূলক মনোভাব পরিহার করতে হবে। শ্রমিকের পাওনাপ্রদানের ক্ষেত্রে তাকে একজন মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে, হাতিয়ার হিসেবে নয়। তাহলে শ্রমিকপক্ষও কাজে আন্তরিক হবে। তাদের হাতে নিরাপদ থাকবে তাদের জীবিকার অবলম্বন মালিকের কারখানা-ফ্যাক্টরি সহায়-সম্পদ। সমাজে শান্তির হাওয়া বইবে। ইসলাম আমাদেরকে এ পথের দিকেই আহ্বান করে। ভারতের বিখ্যাত মনীষী মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি রহ. বলেছেন, “আমার রাশিয়া অবস্থানকালে লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে কথাপ্রসঙ্গে তার কাছে কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতটি বিশ্লেষণ করি—(অর্থ) হে নবী! আপনার কাছে লোকেরা এসে জিজ্ঞেস করে—তারা আল্লাহর পথে কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, প্রয়োজনাতিরিক্ত সবকিছু বিলিয়ে দাও।’ তখন লেনিন অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আরো আগে যদি কুরআনের এই সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতাম, তাহলে আমাদের ‘কম্যূনিজম’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কোনো আবশ্যকই ছিল না।” [মাওলানা শামসুল হক আফগানী কৃত ‘পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলাম’এর সূত্রে ইসলামে শ্রমিকের অধিকার।]

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
ক্যাটাগরি সমূহ
ট্যাগ সমূহ
error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ