Press ESC to close

শৈশব থেকেই শুরু হোক রোযার অনুশীলন

Post Updated at 1 Mar, 2024 – 11:09 AM

শিশুরা নিষ্পাপ, তাদের অন্তর পবিত্র, হৃদয়-মন আয়নার মতো স্বচ্ছ ও নির্মল। তাদের কঁচি মনে ভালো-মন্দ সবকিছুই রেখাপাত করে বিদ্যুৎ গতিতে। বাচ্চারা শৈশবকালে যে শিক্ষা পায় ভবিষ্যৎ জীবনের পরতে পরতে তারই প্রতিফলন ঘটে। একজন ব্যক্তি নামাজ রোযায় কতটা নিষ্ঠাবান ও মুখলিস হবে সেটা অনেকটা নির্ভর করে তার শৈশবের সুশিক্ষা ও ইসলামি পরিবেশে বেড়ে ওঠার ওপর।

সেজন্য শৈশব থেকেই প্রয়োজন রমযানের শিক্ষা, রোযার অনুশীলন। যখন থেকে সম্ভব তখন থেকেই। প্রয়োজন উৎসাহ প্রদান। প্রয়োজন মা-বাবা ও মুরব্বিদের দিক-নির্দেশনা। আদর-সোহাগ করে রমযানের মাহাত্ম্য ও গুরত্ব তুলে ধরতে হবে তাদের সামনে। 

 

এই মাস রহমতের মাস। বরকতের মাস। রমযানের রোযা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। রোযার প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দিবেন। কেমন দিবেন, কত পরিমাণে দিবেন- তা তিনিই জানেন। রোযার অসংখ্য ফজিলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকির সওয়াব দশ গুণ থেকে সাত শ’ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, কিন্তু রোযা আলাদা। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫১; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৯৭১৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৮৯৮৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৬৩৮

অপর একটি হাদীসে রয়েছে:

হযরত আবু মুসা রা. হতে বর্ণিত, আল্লাহ রাববুল আলামীন নিজের ওপর অবধারিত করে নিয়েছেন, যে ব্যক্তি তার সন্তুষ্টির জন্য গ্রীষ্মকালে (রোযার কারণে) পিপাসার্ত থেকেছে, তিনি তাকে তৃষ্ণার দিন (অর্থাৎ কিয়ামতের দিন) পানি পান করাবেন। -মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১০৩৯; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫০৯৫

হাদীসে রোযার আরও অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। তাই নিজেদের যেমন রোযার প্রতি নিষ্ঠাবান ও মুখলিস হতে হবে, তেমনি আমাদের শিশুদেরও রোযার অনুশীলন করাতে হবে। কঁচি মনে ঈমান-আমলের বীজ বপন করতে পারলে বাকি জীবন ঈমান ও ইসলামের নূরে নূরান্বিত হওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।

হাদীসের বর্ণনায় শিশুদের রোযা

হযরত রুবায়্যি‘ বিনতে মুআওয়িজ রা. বলেন, আশুরার দিন সকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের সব পল্লীতে এই নির্দেশ দিলেন, যে ব্যক্তি রোযা রাখেনি, সে যেন দিনের বাকি অংশ না খেয়ে থাকে; আর যে রোযা রেখেছে, সে যেন রোযা পূর্ণ করে। পরবর্তী সময়ে আমরা ওই দিন রোযা রাখতাম এবং আমাদের সন্তানদের রোযা রাখাতাম। আমরা তাদের জন্য জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ওই খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯৬০

ইমাম বুখারী রহ. তাঁর সহীহ বুখারীতে ‘বাবু সাওমিস সিবয়ান’ তথা ছোটদের রোযা শীর্ষক একটি অনুচ্ছেদ কায়েম করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, রমযান মাসে এক নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে ওমর রা. বলেন,

‘আফসোস তোমার জন্য! আমাদের ছোটরা রোযা রাখে আর তুমি রোযা রাখ না!’ -সহীহ বুখারী, বাবু সাওমিস সিবইয়ান

হাদীসের এ সমস্ত বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায়, শিশুদের রোযার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান এবং ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করে তোলা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশেষ করে মন-মগজে রোযার মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ঝালাই করার জন্য শৈশব থেকেই রোযা রাখতে উৎসাহিত করার বিকল্প নেই।

শিশুদের রোযায় অভ্যস্ত করতে করণীয়

  1. শিশুদের কাছে রোযার গুরত্ব ও ফজিলত তুলে ধরা। তাদের কঁচি মনে একথা গেঁথে দিতে হবে যে, সিয়াম পালন জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম। রায়্যান নামে জান্নাতের একটি দরজা আছে, যে দরজা দিয়ে কেবল রোযাদাররা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
  2. প্রথমদিকে দিনের কিছু অংশ রোযা রাখতে উৎসাহিত করা। ক্রমান্বয়ে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সময়কে বাড়িয়ে নেয়া।
  3. রোযা রাখলে শিশুদের পুরস্কৃত করা। এতে তাদের রোযা রাখার প্রেরণা শতগুণ বৃদ্ধি পাবে।
  4. শিশুরা রোযা রাখলে পরিবারের সবার সামনে ইফতার ও সাহরির সময় প্রশংসা করা।
  5. শিশুদের সামনে রমযানের জন্য নিজের কর্মপরিকল্পনা পেশ করা এবং শিশুদের থেকে তাদের পরিকল্পনা শোনা। সে কয়টা রোযা রাখবে, কয়টা সুরা মুখস্থ করবে ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেন শিশুর প্রতি কোনো ধরনের কঠোরতা করা না হয়। অন্যথায় রোযা রাখার ব্যাপারে উদ্দীপ্ত হওয়ার পরিবর্তে বিমুখ হবে। একঘেয়েমি চলে আসবে মন-মানসিকতায়।

এই বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে, সব শিশুকে রমযানের রোযার ব্যাপারে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার বিষয়টি একরকম নয়। এখানে প্রসঙ্গত শিশুদের নামাজের আদেশ করা বিষয়ক হাদীসটি উল্লেখ করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা তোমাদের ছেলেদেরকে সাত বছর বয়সে নামাজের আদেশ করো আর তাদের দশ বছর বয়সে নামাজের জন্য প্রহার করো। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫

এ হাদীসের আলোকে বলা যায়, শিশুর বয়স সাত বছর হলে তাকে রোযার জন্য উৎসাহিত ও উদ্দীপ্ত করলেই যথেষ্ট। কিন্তু বয়স দশ বছর হলে উৎসাহের পাশাপাশি কিছুটা কঠোরতা বা উৎসাহের বিষয়টি আরো তীব্র হওয়া কাম্য, যেন রোযা ফরজ হওয়ার আগেই সে রোযা রাখায় পরিপূর্ণরূপে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। আর যখন একটি শিশু বালেগ হয়ে যায় তখন তার রোযার বিষয়টি কোনোভাবেই শিথিলযোগ্য নয়। একাডেমিক কোনো পরীক্ষা বা অন্য কোনো গুরত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতার দোহাই দিয়ে রোযা ভেঙ্গে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। এতে বাবা-মা বা কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন। 

রোযায় পুরো একটি দিন উপোস থাকতে হয়। বিষয়টি একদমই সহজ নয়। তাই একটি শিশুর বালেগ হওয়ার আগেই রোযায় সক্ষমতা অর্জনের জন্য অভিভাবকের পূর্বপরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। এ জন্য ধীরে ধীরে রোযার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। যেমন, এক বছর পাঁচটি হলে পরের বছর পনেরটি, এর পরের বছর হয়তো পুরো ত্রিশটিই রাখতে পারবে। এভাবে তিন-চার বছরে সে পুরো মাসই রোযা রাখতে সক্ষম হয়ে ওঠবে, ইনশাআল্লাহ।

অভিভাবক অনেক সময় ভয় পান- এ ছোট শিশু সারাদিন কীভাবে না খেয়ে থাকবে! তারা হয়তো এভাবে ভাবেন- বড় হলে রোযা রাখবে, এখন রাখার দরকার কী! যারা এমন ভাবেন তাদের বলব- রোযার মতো একটি কঠিন আমল কেউ চাইলেই হুট করে পূর্ণ এক মাস ধরে আদায় করতে পারবে না। রোযা ফরজ হওয়ার আগে যদি কেউ অভ্যস্ত না হয় তবে সে ক্ষুধা ও অক্ষমতার অজুহাতে রোজা ভেঙে ফেলাও বিচিত্র নয়।

আরেকটি কথা হলো, শিশুরা তো পরিবেশ দিয়ে প্রভাবিত হয়। কারণ তারা যা শোনে,  শিখে তারচেয়ে বেশি। শিখে দেখে দেখে। চারপাশের সবাইকে যখন সে রোযা রাখতে দেখবে, শিশুর উপর প্রভাবটা হবে আরও বাস্তবমুখী ও যথাযথ। তখন সাত বছর হওয়ার আগে থেকেই সে রোযা রাখতে চাইবে, অভিভাবককে অস্থির করে তুলবে। তাই প্রয়োজন অভিভাবকের আগ্রহ ও একটি সুন্দর পরিবেশ, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান লঙ্ঘিত হয় না।

শিশুদের রোযার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ অভিভাবকের একান্ত কর্তব্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

 عبد الله بن عمر يقول: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: «كلكم راع، وكلكم مسئول عن رعيته 

প্রতিটি ব্যক্তি দায়িত্বশীল এবং সে তার অধীনদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৮৯৩

বস্তুত আজকের শিশুই আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। আল্লাহর পথের সৈনিক। হাজারো মানুষের হেদায়েতের উসিলা। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন সে শৈশব থেকেই ঈমান, ইসলাম, নামাজ ও রোযায় অভ্যস্ত হবে। হবে একজন খাঁটি মুমিন, খাঁটি নামাজী ও রোযাদার। আল্লাহ সকল শিশুকে ঈমান, ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কবুল করুন। একজন খাঁটি রোযাদার হিসেবে কবুল করুন। আমীন!


লেখাটি সম্পাদনা করেছেন মাওলানা শিব্বীর আহমদ। উসতাযুল হাদীস, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া ঢাকা, মোহাম্মদপুর।

মাওলানা মাহদী হোসাইন

শিক্ষক: মাজহারুল উলুম মাদরাসা, মিরপুর ১, ঢাকা। দাওরায়ে হাদীস ও ইফতা: জামিউল উলুম মাদরাসা, মিরপুর ১৪, ঢাকা। লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। লেখনীর মাধ্যমে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দিতে চান উম্মাহের মাঝে।

Comments (5)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাইট হিট কাউন্টার

সর্বমোট পোস্ট ভিউ: ২,০৬২,৪৮৫

পোস্ট কপি করার অপশন বন্ধ রাখা হয়েছে। অনুগ্রহ করে পোস্টের লিংক কপি করুন