Post Updated at 27 Sep, 2023 – 11:37 AM

মীলাদুন্নবী উদযাপন ও জন্মদিন পালন বিষয়ে ব্লগ সিরিজে আপনাকে স্বাগতম। এই সিরিজের পোস্টগুলোর শিরোনাম ও লিংক নিচে তুলে ধরা হলো:

  1. প্রসঙ্গ মীলাদুন্নবী : জন্মদিন পালনের ইতিহাস ও ইসলামে জন্মদিন পালনের বিধান
  2. ১২ রবিউল আউয়াল কি নবীজির সা. জন্মদিন? (আপনি এখন এটি পড়ছেন)
  3. ঈদে মীলাদুন্নবীর ইতিহাস ও হাস্যকর কিছু দাবী

জন্মদিন পালন করা যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েয নয়, তবুও আমাদের অনেক স্বজন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন পালন করেন। জন্মদিনের এ উৎসবের নাম তারা দিয়েছেন ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, যারা এ ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করেন, তারা নিজেদের অন্তরে লালিত নবীপ্রেমের কারণেই তা করেন, যদিও তা নবীপ্রেম প্রকাশের সঠিক ও শরিয়তসম্মত পদ্ধতি নয়। কথা হলো, যে তারিখটিতে তারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন পালন করে থাকেন, ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করেন, সে দিনটি কি আসলেই নবীজির জন্মদিন? ইতিহাস কী বলে—এখানে আমরা সে বিষয়টিই আলোকপাত করছি।

 

মূল আলোচনা শুরু করার পূর্বে ভূমিকাস্বরূপ দুটি কথা বলি।

এক. জন্মতারিখ সংরক্ষণ করার তেমন একটা রেওয়াজই তখনকার আরবে ছিল না। এখনকার আধুনিক সমাজে যখন জন্মতারিখের বহুল ব্যবহার, এ সময়েও কি আমাদের সমাজের সকলে সঠিক জন্মতারিখটি ব্যবহার করছেন? অনেকের জন্মতারিখই অনুমাননির্ভর। তো দেড় হাজার বছর আগের মরু আরবের বিষয়টি কেমন হবে—তা তো সহজেই অনুমেয়। মক্কার লোকদের মধ্যে লেখাপড়ার প্রচলনও ছিল কম, আবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের সময় কে জানত—বড় হয়ে তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নবুওয়ত লাভ করবেন? কে জানত—তিনিই হবেন শেষ নবী, যার সুসংবাদ পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবসমূহে দেয়া হয়েছে? কেউ জানত না। তাই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মতারিখটি সংরক্ষিত না থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তী সময়ে যখন মুসলমানদের মধ্যে লেখাপড়ার ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছে, তখনকার নবজাতক শিশুদের, যারা পরবর্তী সময়ে অনেক বড় ব্যক্তিত্ব হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন, তাদের জন্মতারিখও সংরক্ষিত নেই।

দুই. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের কত শত ঘটনা কতভাবে সীরাতের গ্রন্থাবলিতে ছড়িয়ে আছে! জন্ম থেকে নবুওয়ত প্রাপ্তি পর্যন্ত সময়ের বর্ণনা ততটা বিস্তারিত না হলেও বেশ কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আর নবুওয়ত প্রাপ্তির পরের জীবনের ক্ষেত্রে তো বলা যায়—তাঁর পবিত্র জীবনীর বর্ণনা এতটা সবিস্তারে সীরাত ও ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় কারও ক্ষেত্রে তেমনটি আর ঘটেনি। জীবনের সাধারণ থেকে অতিসাধারণ বিষয়গুলো যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি বিশেষ বিশেষ ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে সামান্য কিছু ঘটনার ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট তারিখ প্রমাণিত আছে। যেমন, বদরের যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ, মক্কা বিজয়। সুনির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ না থাকার সংখ্যাই বেশি।

আপনারা জেনে অবাক হবেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজের ঘটনার তারিখটিও সংরক্ষিত নেই। অথচ এ মেরাজ তো কেবল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে একবার ঘটেছে বিষয়টি এমন নয়। বরং পুরো মানবেতিহাসেই এ ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র একবার এবং তা নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে। অথচ এ ঘটনার তারিখটিও সংরক্ষিত নেই। আমাদের সমাজে অবশ্য রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতকে মেরাজের রাত মনে করা হয়। কিন্তু ইতিহাসের আলোকে এ কথাটুকুও জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই—মেরাজের ঘটনা রজব মাসেই হয়েছিল। মাসই যেখানে সুনির্ধারিত নয়, তারিখ সেখানে সুনির্ধারিত থাকার সুযোগ কোথায়!

কথা হতে পারে, এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর তারিখ সংরক্ষিত নেই কেন? এর সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর—যেসব দিন ও ঘটনার সঙ্গে কোনো আমল জড়িত, সেগুলো পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেমন, আশুরা। আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে এ দিনে ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এটি মুহাররম মাসের দশ তারিখের ঘটনা। এর বিপরীতে যেসব দিন ও ঘটনার সঙ্গে কোনো আমল জড়িত নয়, সেসব দিন ও ঘটনার তারিখ অনেকাংশই সংরক্ষিত থাকে নি। সেসব ক্ষেত্রে পরবর্তীকালের ইতিহাস-গবেষকগণ সেসব তারিখ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তাতে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মতারিখও এমনই একটি বিষয়। জন্মতারিখের সঙ্গে যেহেতু কোনো আমল সম্পৃক্ত নয়, তাই তারিখটিও সংরক্ষিত থাকে নি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ধাপ প্রতিটি অধ্যায় সবিস্তারে সীরাতের কিতাবে সংরক্ষিত থাকার পর জন্মতারিখ সুনির্দিষ্টভাবে জানার প্রয়োজনীয়তাও বাকি থাকেনি। এরপরও পরবর্তীকালের গবেষকগণ বিভিন্ন হিসাবনিকাশের আলোকে এ তারিখ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মতারিখ

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মতারিখ ১২ রবিউল আউয়াল—এ কথাটি আমাদের সমাজে প্রচলিত হলেও সহীহ ইতিহাসের আলোকে বিষয়টি প্রমাণিত নয়। নবীজির জন্মতারিখ নিয়ে ইতিহাসের গ্রন্থাদিতে ১০-১২টি মত পাওয়া যায়। আমরা সবগুলো মতের কথা না বলে কেবল অধিক গ্রহণযোগ্য মতগুলো উল্লেখ করছি।

কোন বছর নবীজির জন্ম

ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা এক বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কা মুকাররমার কাবাঘর ধ্বংস করতে এসেছিল। কাবাঘর ধ্বংস করতে এসে তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যায়। এটি ছিল তৎকালীন আরবে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বছরটিও তাই পরিচিতি পায় ‘আমুল ফীল’ বা ‘হাতির বছর’ নামে। ঠিক আমরা যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর বলে থাকি। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ও মুহাদ্দিসের মতে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাতির বছরেই এবং হাতির ঘটনার পঞ্চাশ দিন পর জন্মগ্রহণ করেন।

কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, আমুল ফীল বা হাতির বছরের দশ, ত্রিশ, চল্লিশ বা একাত্তর বছর পর তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। কেউ বলেছেন, হাতির বছরে হাতির ঘটনার দিনেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তবে এ মতগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।

ইমাম ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম অধিকাংশ আলেম ও ইতিহাসবিদের মতে হস্তি বাহিনী ধ্বংসের পঞ্চাশ দিন পর হয়েছিল।

কোন মাসে নবীজির জন্ম

ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ বলেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান, মুহাররম, সফর বা রবিউস সানী মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে তাদের অধিকাংশের কাছেই এসব মত গ্রহণযোগ্য নয়। নির্ভরযোগ্য মত হলো, তিনি রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। ইমাম ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন, অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, তিনি রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।

কোন বারে নবীজির জন্ম?

এক হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করেছেন—তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাই এ নিয়ে আর দ্বিমতের অবকাশ নেই।

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমুল ফীল অর্থাৎ হাতির বছর রবিউল আউয়াল মাসের কোনো এক সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন।

কোন তারিখে নবীজির জন্ম?

তবে সংকট থেকে যায়—তিনি রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন? এ নিয়ে ইতিহাসগবেষকদের নিকট গ্রহণযোগ্য মত চারটি—দুই, আট, নয় ও দশ রবিউল আউয়াল। সবগুলোর পক্ষেই উম্মাহর স্বীকৃত মুহাদ্দিসগণের মত রয়েছে। তাই এর কোনোটিকেই ভিত্তিহীন বলে দেয়া যায় না। তবে এ চারটি মতের মধ্যে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হলো নয় তারিখ। আবার আট ও নয় তারিখের মধ্যে অনেকে এভাবেও সমন্বয় করেছেন—নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আট তারিখ দিবাগত রাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যা কেউ বলেছেন আট তারিখ, কেউ বলেছেন নয় তারিখ। গ্রহণযোগ্যতার বিবেচনায় এরপর দুই তারিখ। এরপর দশ তারিখ। সীরাত গবেষক, মুহাদ্দিস, ইতিহাসবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী—সকল শ্রেণির বিবেচনাই এ রকম।

প্রাচীন কালের গবেষকদের মধ্যে চারজন বিখ্যাত তাবেঈ দুই তারিখের মত ব্যক্ত করেছেন। আট বা নয় তারিখের কথা বলেছেন সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও জুবায়ের ইবনে মুতইম রা. এবং তাবেই ইকরিমা ও মুহাম্মদ ইবনে জুবায়ের রহ.। দশ তারিখের কথা বলেছেন দুইজন তাবেঈ। পরবর্তীকালের গবেষকগণ এ মতগুলোর কোনো একটিকেই সহীহ বলেছেন। আর যারা জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে গবেষণা করেছেন, তারা প্রায় সকলেই নয় তারিখের কথা বলেছেন।

এসবের বিপরীতে বার রবিউল আউয়াল তারিখের কথা বর্ণিত আছে একমাত্র ইবনে ইসহাক রহ. থেকে। তিনি বিখ্যাত সীরাত রচয়িতা। তার সূত্রে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন ইবনে হিশাম রহ.। কিন্তু ইবনে ইসহাকের কোনো সূত্র তিনি উল্লেখ করেননি। পরবর্তী কালের কোনো গবেষকও এ মতটিকে বিশুদ্ধ বলেননি। এমনকি যারা বর্তমানে বার রবিউল আউয়ালে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করেন, তাদের ঘরানার বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ‘আলা হযরত জনাব আহমদ রেজা খান বেরলভীও বলেছেন, রবিউল আউয়াল মাসের দুই বা নয় তারিখ সোমবারই নবীজি জন্মগ্রহণ করেছেন। অন্য কোনো দিন তাঁর জন্মগ্রহণের বিষয়টি অসম্ভব। [নুতকুল হিলাল, পৃ. ২১-২২]

এরপরও কিভাবে যেন আমাদের এ অঞ্চলে নবীজির জন্মতারিখ হিসেবে বার রবিউল আউয়াল তারিখটিই প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। এ দিনে সরকারি ছুটিও থাকে। যারা ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করেন, তারা এ দিনটিকে এখন ‘সকল ঈদের শ্রেষ্ঠ ঈদ’ বলেও প্রচার করছেন।

তাই ইনসাফের দাবি হলো, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের বছর মাস ও বার সংরক্ষিত থাকলেও তাঁর জন্মের তারিখটি অকাট্যভাবে সংরক্ষিত নেই। এ নিয়ে গবেষক আলেমদের মধ্যে বেশ মতবিরোধ হয়েছে। তবে এ মতবিরোধের মধ্যেও বলা যায়, নয় তারিখের মতটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ, এরপর আট তারিখ, এরপর দুই তারিখ, এরপর দশ তারিখ। ১২ রবিউল আউয়াল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মতারিখ হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও বিশুদ্ধ নয়।

এই সিরিজের অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলো পড়ুন:

  1. প্রসঙ্গ মীলাদুন্নবী : জন্মদিন পালনের ইতিহাস ও ইসলামে জন্মদিন পালনের বিধান
  2. ঈদে মীলাদুন্নবীর ইতিহাস ও হাস্যকর কিছু দাবী
Comments
  1. আপনার সাথে কথা বলতে চাই

  2. এই দিনে সাওম পালন কি জায়েজ?

    1. ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করাই শরিয়তসম্মত নয়। তাই এই দিন উপলক্ষে বিশেষ কোনো আমল করার‌‌ও সুযোগ নেই।

  3. একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
ক্যাটাগরি সমূহ
ট্যাগ সমূহ
error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ