
Post Updated at 11 Dec, 2024 – 12:34 PM
তালাক মানবসংসারের এক অনুপেক্ষ অনুষঙ্গ। শান্তির জন্যে, জীবনকে পূর্ণতার পথে এগিয়ে নেয়ার জন্যেই মানুষ আবদ্ধ হয় বিয়ের বন্ধনে। অপরিচিত এক ছেলে আর এক মেয়ের মধ্যে গড়ে ওঠে দৃঢ় এক বন্ধন। এ বন্ধন এ জীবনদুটিকে এতটাই প্রভাবিত করে যে, এর ভিত্তিতে মেয়ে তার চিরচেনা আপন পরিবেশকে ‘পর’ করে দিয়ে অচেনা এক পরিবেশকে আপন করে নেয়। আর ছেলে নিজের জীবন-যৌবন সবকিছু তার নতুন সঙ্গীনির জন্যে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
প্রতিটি মানবজীবনের জন্যেই এ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু এও এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা—জীবনকে স্থির ও শান্তিময় করে তোলার জন্যে যে বিয়ের আয়োজন, সে বিয়েই মাঝেমধ্যে জীবনকে বিষিয়ে তোলে, অস্থিরতা ও অশান্তি ছড়িয়ে দেয় জীবনের প্রতিটি পরতে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়ে বিচ্ছেদের, পা বাড়াতে হয় তালাকের পথে। কখনো আবার পারিপার্শ্বিক কোনো কারণেও তালাকের আশ্রয় নিতে হয়।
তালাক প্রসঙ্গে আরেকটি বাস্তবতা এমনও যে, এ প্রসঙ্গে অজ্ঞতার কারণে বিভিন্ন রকম ভুল হয়ে থাকে। তালাক কখন দেবে, কীভাবে দেবে, কত তালাক দেবে ইত্যাদি নানা দিক থেকে ভুল প্রয়োগ হয় তালাকের। এ অজ্ঞতার পরিমাণ খুব বেশি নয়। দু-চারটি কথা জেনে নিলেই হলো। কিন্তু এ সামান্য অজ্ঞতার কারণে যখন তালাকের ভুল প্রয়োগ হয়, তখন সে ভুলের পরিণতি হয় ভয়াবহ, অসামান্য।
পবিত্র কুরআনে কারীমে যেসব বিষয়ে বিস্তারিত বিধানাবলি বর্ণিত হয়েছে, তালাক সেসবের অন্যতম। তালাক কখন দিতে হবে, কয় তালাক দেবে, কীভাবে তালাক দেবে, তালাক দেয়ার আগে কী কী ধাপ পেরিয়ে আসতে হবে, তালাক দেয়ার পর করণীয় কী—এসবই বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে পাক কুরআনে। লক্ষ করুন—
اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوْنَ عَلَی النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰهُ بَعْضَهُمْ عَلٰی بَعْضٍ وَّ بِمَاۤ اَنْفَقُوْا مِنْ اَمْوَالِهِمْ ؕ فَالصّٰلِحٰتُ قٰنِتٰتٌ حٰفِظٰتٌ لِّلْغَیْبِ بِمَا حَفِظَ اللّٰهُ ؕ وَ الّٰتِیْ تَخَافُوْنَ نُشُوْزَهُنَّ فَعِظُوْهُنَّ وَ اهْجُرُوْهُنَّ فِی الْمَضَاجِعِ وَ اضْرِبُوْهُنَّ ۚ فَاِنْ اَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوْا عَلَیْهِنَّ سَبِیْلًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَلِیًّا كَبِیْرًا ۳۴ وَ اِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَیْنِهِمَا فَابْعَثُوْا حَكَمًا مِّنْ اَهْلِهٖ وَ حَكَمًا مِّنْ اَهْلِهَا ۚ اِنْ یُّرِیْدَاۤ اِصْلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰهُ بَیْنَهُمَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَلِیْمًا خَبِیْرًا ۳۵
পুরুষেরা নারীদের ওপর কর্র্র্তৃত্বশীল, কেননা আল্লাহ তাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে। যারা নেককার নারী, তারা অনুগতা, আল্লাহর সংরক্ষণের মাধ্যমে সে গোপন বিষয়াদির সংরক্ষিকা। তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদেরকে উপদেশ দাও, তাদের বিছানা পৃথক করে দাও এবং তাদের প্রহার করো। এতে যদি তারা তোমাদের কথা মেনে চলে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ তালাশ করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বোচ্চ, মহান। আর যদি তোমরা তাদের দুইজনের মধ্যে বিরোধের আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন শালিশ নিযুক্ত করো। এরা দুজন যদি সমঝোতা চায় তবে আল্লাহ তাদের দুজনের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত। – সূরা নিসা (৪) : ৩৪-৩৫
সংসারে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দেশ করার পর এ আয়াতে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পাশে থাকবে—সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায়, এটাই তো স্বাভাবিক। স্বামী নিজ কাঁধে তুলে নেবে স্ত্রীর ভার আর স্ত্রী থাকবে স্বামীর অনুগত, স্বামীর অনুপস্থিতিতে রক্ষণাবেক্ষণ করবে স্বামীর সংসার, নিজের সতীত্বসহ সবকিছু। কিন্তু কখনো যদি স্ত্রী এড়িয়ে চলতে চায় স্বামীকে, তার কথা না শোনে, শরিয়তের বিধানাবলি তোয়াক্কা না করে, তখনই সৃষ্টি হয় মনোমালিন্য, এরপর ঝগড়া ও দূরত্ব। অনাকাঙ্খিত এমন পরিস্থিতিতে অনেকে শুরুতেই প্রয়োগ করে তালাকের বিষ। তাও এক-দুই তালাক নয়, সরাসরি তিন তালাক! এমনকি সঙ্গে বায়েন তালাকও! ফলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, ভেঙে যায় সাজানো সংসার।
কুরআনের উপরোক্ত আয়াতে আমাদেরকে এ নির্দেশনাই দেয়া হচ্ছে—সম্পর্কের অবনতি হলেই তালাক নয়। বরং যদি কোনো নারীর অবাধ্যতার আশঙ্কা হয়, তবে প্রথমে তাকে বোঝাতে হবে, সুন্দর ভাষায়, সদুপদেশ দিয়ে। হতে পারে, এতটুকুতেই স্ত্রী নিজের ভুল বুঝতে পারবে এবং আবারও অনুগত হয়ে চলতে শুরু করবে। আর যদি এতে কাজ না হয়, তবে তার সঙ্গে এক বিছানায় থাকা বর্জন করতে হবে। তার বিছানা পৃথক করে দিতে হবে। এতে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে স্ত্রীর মনে থাকা যাবতীয় মান-অভিমান। স্বামীর প্রতি অনুগত মন নিয়ে আবারও সে অলঙ্কৃত করতে পারে রাণীর সিংহাসন।
কিন্তু যদি এতেও কাজ না হয়, অবাধ্যতার পথে সে থাকে অটল অবিচল, তখন শেষ চেষ্টা—শাসন। মৃদু আঘাতে স্বামী স্ত্রীকে হালকা শাসন করবে। প্রহার হবে সর্বোচ্চ এতটুকু, যেন শরীরের চামড়া কেটে বা ফেটে না যায় আর চেহারায় কোনো আঘাত করা যাবে না। এভাবে একটু শাসন করবে। এ শেষ ধাপে এসেও যদি স্ত্রীর ভুল ভাঙে, সে সঠিক পথে ফিরে আসে, তবে আর তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না, তার নামে কোনো অভিযোগ করা যাবে না, তাকে নতুন করে আর শাসন করা যাবে না।
যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিরোধ কিছুতেই না মিটে, সদুপদেশ দান, বিছানা পৃথক করা আর হালকা প্রহারের পরও যদি স্ত্রী স্বামীর অনুগত না হয়, তবে তো তালাকের দিকে এগুতেই হবে। কিন্তু তাও এখনই নয়। তালাক দিলে তো সম্পর্ক ছিন্ন হয়েই গেল। জোড়া একটি সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে শেষ আরেকটি পদক্ষেপ এবং এটি পারিবারিক। দুই পরিবারের দায়িত্বশীল দুজন ব্যক্তি তাদের বিষয় নিয়ে ভাববে, তাদেরকে মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। এ চেষ্টাও যদি ব্যর্থ হয়, তবে তারাই তালাকের সিদ্ধান্ত জানাবে।
এটাই আমাদের প্রতি শরিয়তের নির্দেশনা। তালাক যদি দিতেই হয়, তবে এর আগে উপরোক্ত ধাপগুলো পেরিয়ে আসতে হবে। সামান্য মান-অভিমানে কিংবা একটু ঝগড়াতেই হুট করে তালাক নয়। তালাক প্রসঙ্গে শরিয়তের সিদ্ধান্ত তো এমন—তালাক যেভাবেই দেয়া হোক, ভেবেচিন্তে কিংবা মজাচ্ছলে হাসিকৌতুক করে, খামখেয়ালি করে, ঝগড়া করে, রাগ করে, কিংবা কাজী অফিসে বসে, লিখিত বা মৌখিক যেভাবেই হোক, তালাক কার্যকর হয়ে যাবে।
তালাক কার্যকর হওয়ার জন্যে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাক্ষীও লাগে না এবং স্ত্রীকে শুনিয়েও তালাক দিতে হয় না। বিয়ের পর স্বামী তালাকের অধিকার বা সুযোগ লাভ করে। এ অধিকার একবার কাজে লাগিয়ে ফেললে তা আর প্রত্যাহার করার সুযোগ থাকে না; বরং তালাক কার্যকর হয়ে যায়। এ জন্যেই শরিয়ত আমাদেরকে নির্দেশ করছে একবার তালাক দেয়ার আগে শতবার ভেবে দেখার, তালাক প্রয়োগ করার আগে অন্য যত চেষ্টা আছে সব প্রয়োগ করার। যদি কোনোটাতেই কাজ না হয়, তবেই তালাক, এর আগে নয়।
তালাক দিতে হলে কয় তালাক দেবে—এ বিষয়েও ইসলামের নির্দেশনা সুস্পষ্ট এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ। তালাক যদি দিতেই হয়, কেবল এক তালাক দেবে। তাও এমনভাবে, যেন রাজাআত বা ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে। তালাক দেয়ার পর প্রায় সকলেই আবার আগের স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করতে চায়। এটা মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতা। আবার স্ত্রীর পক্ষ থেকেও তালাক ফিরিয়ে নেয়ার আব্দার আসতে পারে। তালাক প্রয়োগের পর স্ত্রী হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পারবে, সঠিক পথে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা লাভ করবে। সে সুযোগটিও রাখা হয়েছে।
আর যদি তালাক প্রত্যাহারের প্রয়োজন না হয়, তবে আর কিছুই করতে হবে না। এভাবেই যখন তালাক পরবর্তী ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে, তখন এ রাজঈ তালাকই বায়েন তালাক হয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়েই আগের বিয়ের সম্পর্কটি সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হবে।
একবার তালাক ফিরিয়ে নেয়ার পর স্ত্রী যদি আবারও আগের ভুল পথে ফিরে যায়, তবে আরও একবার আগের মতোই তালাক দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা দ্বিতীয় তালাক এবং রাজঈ তালাক। এতেও রয়েছে তালাক প্রত্যাহার করে আবারও সংসার করার সুযোগ। আর প্রত্যাহার যদি করা না হয়, তবে ইদ্দত শেষে তালাকে বায়েন হয়ে যাবে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনে এ নির্দেশনাটি এসেছে এভাবে—
اَلطَّلَاقُ مَرَّتٰنِ ۪ فَاِمْسَاكٌۢ بِمَعْرُوْفٍ اَوْ تَسْرِیْحٌۢ بِاِحْسَانٍ
তালাক দুইবার। এরপর হয়তো ন্যায়সঙ্গতভাবে রেখে দেয়া কিংবা সুন্দরভাবে বিদায় দেয়া। – সূরা বাকারা (২) : ২২৯
বলাবাহুল্য, এখানে রাজঈ তালাকের কথা বলা হয়েছে। এজন্যেই তালাক দেয়ার পরও আবার স্ত্রীকে রেখে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তালাক দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে দুইবার। অর্থাৎ একটি করে দুইবারে দুই তালাক দেয়া যাবে। এর বেশি নয়। যদি কেউ তৃতীয় তালাকটি দিয়ে দেয়, তবে এ স্ত্রীকে নিয়ে তার আর সংসার করার সুযোগ থাকে না। পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা—
فَاِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهٗ مِنْۢ بَعْدُ حَتّٰی تَنْكِحَ زَوْجًا غَیْرَهٗ ؕ فَاِنْ طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَیْهِمَاۤ اَنْ یَّتَرَاجَعَاۤ اِنْ ظَنَّاۤ اَنْ یُّقِیْمَا حُدُوْدَ اللّٰهِ ؕ وَ تِلْكَ حُدُوْدُ اللّٰهِ یُبَیِّنُهَا لِقَوْمٍ یَّعْلَمُوْنَ ۲۳۰
এরপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে স্ত্রী আর স্বামীর জন্যে বৈধ হবে না, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কোনো স্বামীকে বিয়ে করে। এরপর যদি (পরবর্তী) স্বামী তাকে তালাক দেয়, তখন তারা (অর্থাৎ প্রথম স্বামী ও স্ত্রী) আবার একে অন্যের কাছে ফিরে আসাতে কোনো গোনাহ হবে না, যদি তারা ধারণা করে—তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করতে পারবে। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা, তিনি তা এমন সম্প্রদায়ের জন্যে বর্ণনা করেন, যারা জানে। – সূরা বাকারা (২) : ২৩০
এভাবেই ইসলামি শরিয়তে একে একে তিনটি তালাককে বৈধ করা হয়েছে। প্রথম দুটি যদি রাজঈ তালাক হয় তবে ইদ্দতের মধ্যে সহজেই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়া যাবে। ফিরিয়ে না নিলে এ রাজঈ তালাকই ইদ্দত শেষে বায়েন তালাক হয়ে যাবে। এমনকি যদি প্রথমেই একবার বা দুইবার বায়েন তালাক দেয়া হয়, তবুও সুযোগ থাকবে এ স্বামী-স্ত্রী আবারও সংসারে একত্রিত হওয়ার। তবে তখন শুধু রাজআত বা ফিরিয়ে নিলেই হবে না, বরং বিয়ে নবায়ন করতে হবে, নতুন মোহর ও সাক্ষীসহ। এটা ইদ্দতের মধ্যেও হতে পারে, ইদ্দত শেষ হওয়ার পরও হতে পারে।
রাজঈ তালাক দেয়ার পর যদি তা প্রত্যাহার করা না হয় এবং এজন্যে তা ইদ্দত শেষে বায়েন হয়ে যায়, এরপরও বিয়ে নবায়নের মাধ্যমে তাদের আবারও সংসার করার সুযোগ থাকবে। শরিয়তের শিক্ষা ও নির্দেশনা হলো—তালাক যদি দিতেই হয় তো দাও, তবে শুরুতেই সব পথ বন্ধ করে নয়। আবারও আগের সংসারে ফিরে যাওয়া যায়, ভুলত্রুটি ভুলে গিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করা যায়—এ সুযোগটি হাতে রেখে তালাক দাও। আর এ জন্যে একটাই পথ—একসঙ্গে তিন তালাক না দেয়া। একসঙ্গে তিন তালাকের কথা মুখ থেকে বেরিয়ে গেলে আর কোনো সুযোগই থাকে না।
এ বিষয়টি আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষেরা, বলতে গেলে, একেবারেই জানে না। তারা মনে করে, তালাক দিতে হলে এভাবেই দিতে হয়—এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বায়েন তালাক! দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজের অনেক কাজী সাহেব, যারা সরকারি নিয়মে বিবাহ ও তালাক নথিভুক্ত করে থাকেন, তারাও জানেন না। পারিবারিক অশান্তিতে জর্জরিত হয়ে তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন কেউ তাদের কাছে যায় এবং তালাকের বিষয়টি তাদের হাতে অর্পণ করে, তখন তারাও একসঙ্গে এ তিন তালাক প্রয়োগ করে।
এমন ঘটনা আমাদের সমাজে একটি-দুটি নয়, অজস্র। এরপর যখন রাগ দমে যায়, কিংবা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, অথবা স্ত্রী কাকুতিমিনতি করে, তখন আবারও সংসার করতে চায় ঠিক। কিন্তু তখন শরিয়তের দৃষ্টিতে তার সামনে আর কোনো সুযোগ থাকে না। সে তখন নিষিদ্ধ হিলার পথে হাঁটে কিংবা শরিয়তের বিধানকে উপেক্ষা করে।
হিলা যদি নিয়মমাফিক হয়, তবে এতে তার স্ত্রী তার জন্যে হালাল হয়ে যাবে ঠিক, কিন্তু এ হিলা তো শরিয়তে অভিশপ্ত এক কাজ। হিলা করার জন্যে যার কাছে বিয়ে দেয়া হবে, তাকে তুলনা করা হয়েছে ভাড়া করা ষাড়ের সঙ্গে। আর যদি মান-সম্মান, চক্ষুলজ্জা কিংবা অন্য কোনো কারণে সোজা শরিয়তের বিধানকেই উপেক্ষা করে এবং তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সংসার চালিয়ে যায়, তবে এতে খুলে যায় যিনা-ব্যভিচারের দুয়ার। সামান্য একটু অসতর্কতা ও অজ্ঞতার কারণে দুটি জীবন এভাবেই অনিঃশেষ হারামে জড়িয়ে পড়ে।
ইসলামি ফিকহের পরিভাষায়, একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া হলে তাকে বলা হয় ‘আততালাকুল বিদঈ’ বা বিদআতী তালাক। এটা নিষিদ্ধ। তালাক দিতে হলে উপরোক্ত বিধান অনুসারে দিতে হবে। ভেবেচিন্তে দেবে, হুট করে নয়, রাগ করেও নয়। এমনকি হাদীসে তো এ কথাও বলা হয়েছে—তালাক স্ত্রীর অপবিত্র অবস্থায় দেবে না এবং এমন পবিত্র অবস্থায়ও নয়, যে পবিত্রতায় তার সঙ্গে শারীরিক মেলামেশা হয়েছে। এসব বিধান মেনে যদি তালাক দেয়া হয়, তালাক দেয়ার আগে যদি এর পূর্ববর্তী ধাপগুলো মেনে চলা হয়, তবে সে তালাক কোনো সংকটের কারণ হবে না। বরং তালাক হবে আগের জীবনের ভুল শোধরানোর সুযোগ কিংবা উভয়ের জন্যেই নতুন করে অন্য কারও সঙ্গে সংসারের ভূমিকা।
সামান্য ঝগড়াতেই তালাক নয় এবং ‘তালাক মানেই তিন তালাক নয়’—তালাক প্রসঙ্গে এতটুকু ইলমও যদি আমাদের ব্যাপকভাবে থাকত, তবে আমাদের সমাজের চিত্রটা ভিন্ন হতো। দীর্ঘদিনের সাজানো সংসার এত সহজে ভেঙে যেত না। ঘৃণিত হিল্লা বিয়ের দ্বারস্থও আমাদের হতে হতো না। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালিয়ে যাওয়ার মতো হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহসও কাউকে দেখাতে হতো না। সমাজের যারা কর্তাব্যক্তি কিংবা দীনি অভিভাবক, তাদের কাছে এসে কাউকে সন্তানের দোহাই দিয়ে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করার পথও তালাশ করতে হতো না। এ জন্যে প্রয়োজন—একটু সচেতনতা, আম-খাস সকল মুসলমানের। সামান্য এ সচেতনতাই আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে অসামান্য পরিণতি থেকে।
Comments (21)
MD JAKARIA KHANsays:
December 5, 2024 at 12:48 AMAllah give us proper knowledge of Islam. Ameen.
নাজমুন নাহারsays:
December 6, 2024 at 12:05 PMখুব প্রয়োজনীয় একটা লিখা।সবার পড়া উচিত। save করব কিভাবে? আমিও একজন ভুক্তভোগী।
আমাতুর রহমানsays:
December 6, 2024 at 3:48 PMদুইবার রাজঈ তালাক ও একবার বায়েন তালাক হলে কি পূর্বের স্বামীর সাথে পুনরায় সংসার করার কোনো সুযোগ থাকে?
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
December 11, 2024 at 12:21 PMএতে তো তিন তালাক হয়ে গেলো। তিন তালাকের পর এ সুযোগ স্বাভাবিকভাবে থাকে না। এটাই শরিয়তের বিধান।
Maharun Nasasays:
December 6, 2024 at 6:21 PMকোনো মহিলা কি তালাক দিতে পারবে?? এ বিষয়ে ইসলাম কি বলে?
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
December 11, 2024 at 12:20 PMপারবে, তবে কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন, স্বামীর পক্ষ থেকে তাকে তালাকের অধিকার দিতে হবে। এরপর সে অধিকারের ভিত্তিতে স্ত্রী নিজেকে তালাক দেবে বা নিজের ওপর তালাক প্রয়োগ করবে। স্বামীকে স্ত্রী তালাক দিতে পারে না।
রোজাsays:
December 6, 2024 at 8:19 PMএখানে সব ঠিক বলেছেন
কিন্তু একটা জিনিস ভুল হয়েছে সেটা হল আল্লাহ তায়ালা কোরানে বলেন যে যদি কোনো স্বামী ভুল করে বা রাগের মাথায় তার স্ত্রীকে ৩ তালাক প্রদান করে, তাহলে সে যদি পরে তার ভুল বুঝতে পারে, সে অবশ্যই তার স্ত্রীকে আবার নতুন করে বিয়ে করতে পারবে। এর জন্য তার স্ত্রীকে অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করতে হবে না।
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
December 11, 2024 at 12:19 PMআপনি যে তথ্য দিয়েছেন, তা পবিত্র কুরআনের কোথাও নেই। আশা করি, এ বিষয়ে আপনার আরও জানার সুযোগ হলে আপনার এ বিভ্রান্তি কেটে যাবে।
হোসনে আরাsays:
December 7, 2024 at 4:42 AMপিরিয়ডের সময় কি তালাক দিলে তার তালাক হয়ে যাবে ?
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
December 11, 2024 at 12:16 PMতালাক হয়ে যাবে, তবে এমনটি করা নিয়মবহির্ভূত।
মুনিয়াsays:
December 8, 2024 at 5:09 AMযেসব সামী বিনা কারনে কথায় কথায় তালাক দেয় সেক্ষেত্রে স্ত্রীর করনীয় কি?স্ত্রীর যাওয়ার কোনো জায়গাও নাই এমনকি সে তালাকও চায়নি।সেসময় একটা মেয়ে কি করবে?
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
December 11, 2024 at 12:16 PMকথায় কথায় তালাক দেয়া তো তালাক সম্পর্কে অজ্ঞতারই ফল।
মো: জহিরুল ইসলামsays:
December 8, 2024 at 6:25 AMযখন কোনো স্ত্রী স্বামীকে বনিবনা হচ্ছে না কারণ দেখিয়ে তালাক দেয়। সেটা কি তালাক হয়? সে যদি তালাক নোটিশ দিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে করে সে বিয়ে কি সঠিক হবে? বিস্তারিত উত্তর জানিয়ে উপকৃত করবেন।
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
December 11, 2024 at 12:15 PMস্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দেয়, তাহলে তো তালাক হবে না। তালাক স্ত্রী নিজেকে দেবে। এ বিষয়ে আমরা পরবর্তীতে ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করব।
শাহ হাদিউজ্জামানsays:
December 8, 2024 at 6:27 AMআলহামদুলিল্লাহ এই লেখা পড়ে অনেক কিছু জানা হলো সবার পড়ার দরকার যে কেউ উপকৃত হবে ।
তানজিনাsays:
December 11, 2024 at 4:43 PMস্বামী যদি ঘরে স্ত্রী রেখে অন্য নারীর সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত হয় এবং এই স্ত্রীকে প্রয়োজনীয় অর্থ না দেয়। এক্ষেত্রে স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দেয় তাহলে এই তালাক কি হবে?
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
January 22, 2025 at 5:29 PMপ্রথম কথা হলো, স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। তালাক স্বামী স্ত্রীকে দেবে কিংবা স্বামীর পক্ষ েথেকে দেয়া অধিকারের ভিত্তিতে স্ত্রী নিজেকে তালাক দিবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে তো স্ত্রী নিজেকে তালাক দিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবে, যদি তাকে অধিকার দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু যদি অধিকার দেয়া না হয়, তাহলে স্বামীর কাছে তালাক চাইবে কিংবা আদালতের শরণাপন্ন হবে। এক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে বিষয়টি মীমাংসা হলেই ভালো হয়।
নাফিজাsays:
December 26, 2024 at 9:20 AMযদি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দেওয়া হয় থাকে, কিন্তু এই বিষয়ে স্বামী কিছু জানে না , মানে এই অধিকার দেওয়ার বিষয় লিপিবদ্ধ করার সময় তার থেকে মতামত বা অনুমতি নেওয়া হয় নাই l
সেক্ষেত্রে স্ত্রী তার স্বামীকে তালাকের নোটিশ পাঠালে বা তালাক দিলে এবং স্বামী যদি তাতে সিগনেচার না করে বা তালাক না দেয় সেইটা কি হবে?
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
January 22, 2025 at 5:18 PMস্বামীর পক্ষ থেকে যদি স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দেয়া হয়, তা যদি স্বামীর অজ্ঞাতসারে কিংবা তাকে না জানিয়েও হয়, কিন্তু স্বামী সে অধিকার প্রদান সম্বলিত কাগজে স্বাক্ষর করে, তবে স্ত্রী তালাকের অধিকার প্রাপ্ত হবে। এ অবস্থায় স্ত্রী যদি নিজের ওপর তালাক প্রয়োগ করে, তাহলে তালাক হয়ে যাবে, স্বামী যদি না জানে কিংবা রাজি না থাকে, তবুও।
উল্লেখ্য, প্রাপ্ত অধিকারের ভিত্তিতে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারবে না। তালাক স্ত্রীর ওপর পতিত হয়, স্বামীর ওপর নয়। তাই স্ত্রী নিজের ওপর তালাক প্রয়োগ করবে।
Marjana Aktersays:
May 14, 2025 at 7:17 PMস্বামী যদি কাউকে বলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আর একসাথে থাকা সম্ভব না।
তাহলে কি তালাক পতিত হবে?
কিংবা আকার ইঙ্গিতে তালাকের বিষয়টা ইঙ্গিত করে তাহলে সে ক্ষেত্রে করণীয় কি?
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
May 18, 2025 at 8:21 PMনা, এতটুকু কথাতে তালাক হবে না। উল্লেখ্য, তালাকের বিষয়টি খুবই জটিল। তাই ঘটনার হুবহু বিবরণ উল্লেখ করে আস্থাভাজন কারও কাছ থেকে মাসআলা জেনে নিতে হবে।