Post Updated at 23 May, 2023 – 7:31 AM

হজ একটি প্রেমসিক্ত ইবাদত

সামনেই জিলহজ মাস। ঘনিয়ে আসছে হজ। সারা দুনিয়া থেকে হজ আদায়ের উদ্দেশ্যে এখন হেজাজের পবিত্র ভূমির দিকে ছুটে চলছে হাজী সাহেবদের কাফেলা। রমজানের দীর্ঘ এক মাসের সংযম-সাধনার পর যেদিন আমরা ঈদুল ফিতর পালন করেছিলাম, সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেছে হজের সময়ও। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ঘোষণাÑ
اَلْحَجُّ اَشْهُرٌ مَّعْلُوْمٰتٌ
হজ নির্ধারিত কয়েকটি মাস। Ñসূরা বাকারা (২) : ১৯৭
হজের এ কয়েকটি মাসের গণনা শুরু হয় শাওয়াল থেকে, শেষ হয় জিলহজে। হজ আদায়ের মূল সময় যদিও ৮ জিলহজ থেকে শুরু হয়, কিন্তু হজের নিয়তে ইহরাম পরার সময় শুরু হয় এ শাওয়াল থেকে, ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে। রমজানের ফরজ রোজার পর্ব শেষ করামাত্রই তাই আমরা ঢুকে পড়েছি আরেক মহান ইবাদতের সময়ে।

 

এ ইবাদত একটি প্রেমসিক্ত ইবাদত। এখানকার প্রায় প্রতিটি বিষয়ই এমন, যা মানুষের মেধা ও যুক্তির উর্ধ্বে। প্রেমাষ্পদ প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রেমিক বান্দাদের এ ইবাদতটি পালন করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা জানার জন্যে এ একটি আয়াতের নির্দেশনাই যথেষ্টÑ
وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا ؕ وَ مَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الْعٰلَمِیْنَ۝
মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ করা তার অবশ্যকর্তব্য। এবং কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন! Ñসূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭
সামর্থ্য যার আছে, তার জন্যে জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এ বিধান যদি কেউ উপেক্ষা করে তার জন্যে এর চেয়ে কড়া সতর্কবাণী আর কী হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে বলছেন : ‘সে জেনে রাখুক, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন’? কিন্তু জীবনে একবার এই হজ পালন করাÑ এটা তো আইনের কথা। একবার হজ করা যেহেতু ফরজ, তাই পরবর্তীতে আর কখনো হজ আদায় না করলে কেউ গোনাহগার হবে না, এজন্যে কাউকে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে না। তবে কথা কী, প্রেমিকের মন প্রেমাষ্পদের সেই ঘরের দর্শন থেকে, প্রেমসিক্ত এই ইবাদত থেকে নিজেকে নিবৃত করতে পারে না। তাই সে বারবারই ছুটে যায় ওই ঘরের আকর্ষণে, কখনো হজের নিয়তে, কখনো উমরার নিয়তে। যেতে না পারলেও মনটা পড়ে থাকে ওখানে। কাউকে যেতে দেখলে ঈর্ষান্বিত হয়ে সেও যেতে আকুল হয়। আসলে সম্পর্ক যেখানে ভালোবাসার, সেখানে কি আইন দিয়ে বাধ দেয়া যায়! লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির⸺এভাবে নিজের উপস্থিতির ঘোষণা এই একটিমাত্র ক্ষেত্রেই করা যায়।

বিস্ময়কর বিধান বিস্ময়কর পুরস্কার

হাদীস শরীফে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হজ ও উমরার কত চমৎকার পুরস্কারের কথা শুনিয়েছেন, লক্ষ করুনÑ
تَابِعُوا بَيْنَ الحَجِّ وَالعُمْرَةِ ، فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الكِيرُ خَبَثَ الحَدِيدِ ، وَالذَّهَبِ ، وَالفِضَّةِ
তোমরা বারবার হজ-উমরা আদায় করো। কেননা এ দুটি আমল দরিদ্রতা ও গোনাহ মিটিয়ে দেয়, যেভাবে হাপর লোহা ও স্বর্ণ-রোপার মরিচা দূর করে। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৮১০
হজ ও উমরার এ আরেক বিস্ময়কর পুরস্কার। লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে যখন কেউ হজ করতে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে অভাবে আক্রান্ত হওয়ার কথা, তার সম্পদ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করছেন তার অভাব দূর হয়ে যাওয়ার পুরস্কার! আমাদের সীমিত যুক্তি তা মেনে নিতে পারুক কিংবা না-ই পারুক, এর বাস্তবতা আমাদের সমাজেই এক স্বীকৃত বিষয়।
আসলে হজের পুরো বিষয়টাই এরকম। যে কথা উপরে বলে এলামÑ হজের প্রায় সকল বিধানই আমাদের মেধা ও যুক্তির উর্ধ্বে। যেমন, হজের শুরুটা হয় ইহরামের মধ্য দিয়ে। কেউ যখন ইহরাম পরিধান করে, তখন থেকে হাজী সাহেবের ওপর আরোপিত হয় কিছু বিধিনিষেধ। এমন কিছু কাজ তার জন্যে তখন নিষিদ্ধ হয়ে যায়, যেগুলো এর আগে তার জন্যে সম্পূর্ণই বৈধ ছিল। এখানেই শেষ নয়, ইহরাম-পরিহিত অবস্থায় এমন কিছু কাজও নিষিদ্ধ হয়ে যায়, ইহরামমুক্ত অবস্থায় যেগুলো পালন করতে আমরা একপ্রকার আদিষ্টও। উদাহরণস্বরূপ নামাজের কথা বলা যায়। স্বাভাবিকভাবে নামাজের সময় ভালো কাপড়চোপর পরারই কথা বলা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। অথচ ইহরাম-অবস্থায় সেলাইযুক্ত কোনো কাপড়ই গায়ে চড়ানো যায় না। সেলাইবিহীন দুটি সাদা কাপড়েই কাটিয়ে দিতে হয় তার পুরো সময়। ইহরামমুক্ত অবস্থায় যদি কেউ খোলা মাথায় নামাজ পড়ে তাহলে বিষয়টি মাকরুহ তথা অপছন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়। অথচ ইহরাম পরিধানের পর মাথায় টুপি দেয়া বরং নিষিদ্ধ। পরিচ্ছন্নতা সর্বাবস্থায় ইসলামের একটি পছন্দনীয় বিষয়। একজনের অপরিচ্ছন্নতায় যেন আরেকজন কষ্ট না পায়⸺এ বিষয়টি সবিশেষ লক্ষণীয়। এ পরিচ্ছন্নতা হাসিলের লক্ষ্যেই জুমার দিনের গোসলের বিধান দেয়া হয়েছে। শুধু শরীর নয়, বরং বাড়িঘর এমনকি আঙ্গিনা পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে ইসলাম-অনুসারীদের। অথচ ইহরাম পরিহিত অবস্থায় শরীরের অপরিচ্ছন্নতা দূর করা যাবে না। প্রয়োজনে গোসল করা যাবে, কিন্তু সাবান ব্যবহার করা যাবে না। ঘষামাঝা করে শরীরের ময়লা পরিষ্কার করা যাবে না। শরীরে-জামায় সুগন্ধি ব্যবহার করা, মাথার চুলগুলো চিরুনি দিয়ে পরিপাটি করে রাখা ইত্যাদি স্বাভাবিক সময়ে কাক্সিক্ষত হলেও ইহরাম পরিহিত অবস্থায় সবই নিষিদ্ধ। অথচ এ সময় স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা যাবে, খাওয়াদাওয়াও করা যাবে। ঘুমানো যাবে। মানবিক প্রয়োজনগুলোও পূরণ করা যাবে। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা অর্জন, আতর-সুগন্ধি ব্যবহার, সেলাইযুক্ত কাপড় কিংবা মাথায় টুপি ব্যবহার ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপেই নিষিদ্ধ। বাহ্যত এসবের পেছনে কোনো যুক্তি নেই। অথচ এরই নাম হজ। এই হজ প্রেমিক বান্দাদের জন্যে ভালোবাসার এক পরীক্ষা। প্রেমাষ্পদ প্রভু তাঁর প্রেমিকদের প্রেমের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন⸺ভালোবাসায়, প্রেমে আসলে সে কতটা নিখাঁদ? যুক্তির পেছনে পড়ে সে প্রেমাষ্পদের হুকুমকে দূরে ঠেলে দেয়, না প্রভুর হুকুমের সামনে যুক্তিকে আছড়ে ফেলে? হাজী সাহেবগণ প্রেমাষ্পদ প্রভুর বিধানকে মাথায় তুলে নিয়ে এভাবেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন।

 

স্বপ্নের বাইতুল্লাহর ছায়ায়

ইহরামের চাদর গায়ে জড়িয়ে অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে যখন প্রেমিক বান্দা চলে আসেন বাইতুল্লাহর চত্বরে, বহুদিনের লালিত আকাঙ্ক্ষা যখন তার সামনে বাস্তবরূপে হাজির, তখন প্রথমে তাকে সুযোগ দেয়া হয়⸺কালো গিলাফে ঢাকা প্রেমাষ্পদের এই ঘর প্রাণভরে দেখো আর মনের সব আর্জি সেই মহান মালিকের কাছে, এই ঘরের মালিকের কাছে তুলে ধরো। কিন্তু এরপরই যখন তিনি তওয়াফ শুরু করতে যাবেন, কাবাঘরকে বামদিকে রেখে হাঁটতে শুরু করবেন, তখনই তাকে বলা হবে⸺ডানে-বামে না তাকিয়ে কেবলই সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে হেঁটে যাও। কাবাঘরটি এত কাছে, অথচ সেই ঘরের দিকে তাকিয়ে থেকে তওয়াফ করার বিধান নেই। অন্য সব মসজিদের মতো এখানকার মসজিদুল হারামেও নামাজ হয়, তেলাওয়াত জিকির-আজকার সবই হয়। আর পৃথিবীর সর্বত্রই মুসলমানগণ তো এই কাবাঘর আর মসজিদুল হারাম অভিমুখী হয়েই তাদের নামাজ আদায় করে থাকে। কিন্তু তওয়াফ আর অন্য কোনো মসজিদে করা যায় না। অন্য কোনো স্থানেও করা যায় না। এ তওয়াফই এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। তওয়াফ চলাকালে প্রেমাষ্পদের ঘরটি যেখানে ইচ্ছা সেখানেই আবার ছুঁয়ে দেখারও বিধান নেই। একটি নির্দিষ্ট কোণায় হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। আরেক কোণায় স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরটিতে সুযোগ হলে চুমু খাওয়া, না পারলে হাতে স্পর্শ করে হাতে চুমু খাওয়া, তাও সম্ভব না হলে হাত দিয়ে ইশারা করে সেই হাতে চুমু খেতে বলা হয়েছে। কিন্তু এর পরেই সামান্য একটু জায়গা, যার নাম মুলতাযাম, হাজরে আসওয়াদ থেকে কাবাঘরের দরজা পর্যন্ত জায়গাটুকু, এখানে আর কোনো বাধাবিঘœ নেই। এখানে এসে সম্ভব হলে একেবারে জড়িয়ে ধরার কথা বলা হচ্ছে। বুক, গাল লাগিয়ে দিয়ে মনকে তৃপ্ত করে নাও আর প্রেমাষ্পদ প্রভুকে যা বলার বলো। আল্লাহকে দেখার সুযোগ আমাদের নেই। দুনিয়াতে এই ঘরটি তাঁর এক নিদর্শন। ‘আল্লাহর ঘর’ বলে আমরা এই ঘরটিকেই বুঝি। এই ঘরের এত কাছে আসার, এভাবে আল্লাহর ঘরকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ কাজে লাগাও। নিজের আবেগ-অনুভূতি চাওয়া-প্রার্থনা সব এখানে উজাড় করে দাও। দুনিয়ার এ জীবনে যে প্রেমাষ্পদের এর চেয়ে বেশি কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ নেই!
এরপর সাফা-মারওয়ার সাঈর পালা। সায়্যিদুনা ইসমাঈল আলাইহিস সালামের শিশু বয়সে তাঁর জন্যে তাঁর মা হযরত হাযেরা রা. যখন পানির সন্ধানে ব্যাকুল, সাফা-মারওয়ার মাঝে বারবার ছুটোছুটি করছিলেন, তখন আল্লাহ আরেক নিদর্শনের প্রকাশ ঘটান এই হারামের চত্বরে। সৃষ্টি হয় রহমতের পানির এক অনিঃশেষ ফোয়ারা। মা হাযেরা রা.-র সেই স্মৃতিই বারবার ফিরে আসে সাফা-মারওয়ার সাঈতে।

 

মিনা-মুযদালিফা-আরাফায়

সাঈর পর মাথা হলক করে ইহরাম থেকে মুক্ত হতে হয়। ইহরামমুক্ত অবস্থায় আবার সেখানে স্বাভাবিক প্রায় সবকিছুই করা যায়। এরপর যখন ধীরে ধীরে হজের মূল সময় ঘনিয়ে আসে, জিলহজ মাসের ৮ তারিখ চলে আসে, তখন তাকে চলে যেতে হয় মিনার প্রান্তরে। মিনার তাবুতে কাটাতে হয় এক দিন। পরের দিন ফজরের নামাজ শেষে ছুটে যেতে হয় আরাফার মাঠে। ওই দিনই সন্ধ্যায় আবার ছুটতে হয় মুযদালিফার দিকে। এই যে মসজিদে হারামে নামাজ রেখে মিনা-আরাফা-মুযদালিফায় ঘুরে বেড়ানোÑ এর কি কোনো ব্যাখ্যা করা যাবে! মসজিদে হারামে এক রাকাত নামাজ অন্য জায়গার এক লক্ষ রাকাত নামাজের সমান। এত এত টাকা খরচ করে হাজী সাহেব যখন মসজিদে হারামে উপস্থিত, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত সে মসজিদে হারামেই আদায় করছে, তখন তাকে বলা হচ্ছে⸺এবার মিনায় চলো। সওয়াব ও ফজিলতের এত আধিক্য সত্ত্বেও এখন আর মক্কায় থেকে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাকে ছুটতে হবে মিনায়। কথা ওই একটাই⸺আমাদের বিবেক যুক্তি আর বোধের অনেকটাই উর্ধ্বে হজের প্রায় সকল বিধান। ‘এটা কেন’⸺এ কথা বলার সুযোগ নেই হজের কোনো আমলের ক্ষেত্রেই। আসলে এ আপত্তি তো ইসলামের কোনো বিধানের ক্ষেত্রেই করার সুযোগ নেই। তবে পার্থক্য হলো, ইসলামের অন্যান্য বিধান সাধারণত এমন, যেগুলোর রহস্য আমরা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারি। কিন্তু হজের বিধানগুলোই এর ব্যতিক্রম। এখানে কেবলই প্রেম-ভালোবাসার খেলা। আল্লাহর হুকুম⸺ব্যাস, এতটুকুই যথেষ্ট। আপন মনে বান্দা এতেই মত্ত।
কথা এখানেই শেষ নয়, আরাফার মাঠের উপস্থিতি হচ্ছে হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ যদি নির্ধারিত সময়ে এখানে উপস্থিত হতে না পারে, তাহলে তার হজটিই বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানটি পালনের মুহূর্তে আবার নামাজের সময় এলোমেলো করে দেয়া হয়েছে। আরাফার মাঠে যারা অবস্থান করবে, বিশেষ করে সেখানকার মসজিদে নামিরার জামাতের সঙ্গে যারা নামাজ আদায় করবে, তারা জোহর ও আসরের নামাজ একইসঙ্গে জোহরের সময়ে আদায় করবে। আবার সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে যখন মাগরিবের নামাজের সময় শুরু হবে, তখন মাগরিব পড়া যাবে না। মাগরিব আদায় করতে হবে ইশার সময় মুযদালিফায় গিয়ে। এমনকি যদি কেউ ইশার সময় হওয়ার আগেই মুযদালিফায় পৌঁছে যায়, সেও মাগরিবের নামাজ আদায় করার জন্যে অপেক্ষা করবে ইশার সময় শুরু হওয়ার। কেউ যদি জীবনে একবারের জন্যেও মাগরিবের নামাজ কাজা করে না থাকে, তবুও তার জন্যেও এই একই বিধান। মাগরিব পড়তে হবে ইশার সময়। সারা বছর যেখানে ফজরের নামাজ একটু ফর্সা হলেই পড়া মুস্তাহাব, সেখানে মুযদালিফার রাতের পরদিন সকালে একটু আগেভাগেই ফজরের নামাজ পড়ে নেয়াটাই নিয়ম। এরপর আবার মিনা। তিন দিন সেখানে অবস্থান আর প্রতিদিন শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ। যে শয়তান এখানে একদিন ধোঁকা দিতে চেষ্টা করেছিল সায়্যিদুনা হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে, ওই শয়তান তো আর এখানে বসে নেই। কিন্তু সেই স্মৃতিকে সামনে রেখে কঙ্কর নিক্ষেপ করে থাকেন হাজী সাহেবগণ। লক্ষ লক্ষ হাজী সাহেবের কোটি কোটি কঙ্কর। কেনই-বা এই কঙ্কর নিক্ষেপ! আর কঙ্করগুলোও যায় কোথায়! দয়াময় প্রভুর এক আজব কুদরত!

 

হজ : অনেক সহজ অনেক কঠিন

এক বিবেচনায় হজ তো খুব সহজ একটি আমল। শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় নির্ধারিত সময়ে অবস্থান, কঙ্কর নিক্ষেপ আর তওয়াফ-সাঈ⸺এই তো হজ। এর কোথাও এমন কোনো দোয়া নেই, যা না পড়লে হজ ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়বে। আগে থেকে কিছুই না জানা থাকলেও, যদি কেবলই কাফেলার অন্য সবার সঙ্গে থাকে, আর তাদের দেখাদেখি এ কাজগুলো করে, তাহলেই হজ হয়ে যাবে। কিন্তু এর অপর পিঠটিই অত্যন্ত কঠিন। দীর্ঘ সফর, দীর্ঘ প্রস্তুতি, বড় অঙ্কের ব্যয় ইত্যাদি তো আছেই। এর পাশাপাশি হজের সময়গুলোতে কড়াভাবে নিষিদ্ধ হয়ে আছে ঝগড়াঝাটি আর পাপকর্ম। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা :
اَلْحَجُّ اَشْهُرٌ مَّعْلُوْمٰتٌ ۚ فَمَنْ فَرَضَ فِیْهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوْقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الْحَجِّ ؕ
হজ নির্ধারিত কয়েকটি মাস। তাই যদি কেউ সেগুলোতে হজ অবধারিত করে নেয়, তাহলে হজের মধ্যে স্ত্রী-সম্ভোগ পাপাচার কিংবা ঝগড়া করতে পারবে না। Ñসূরা বাকারা (২) : ১৯৭
এভাবে নিয়ম মেনে যে হজ করতে পারে, হজের সফরকে যে কোনো গোনাহে কলঙ্কিত করবে না, তার হজকে বলা হয় ‘মাবরুর হজ’। বাংলায় একে আমরা কবুল হজও বলতে পারি। এ মাবরুর হজকে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন শ্রেষ্ঠ আমল। সহীহ বুখারীর হাদীস, হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শ্রেষ্ঠ আমল কোনটি? তিনি উত্তরে বলেছেন : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা।
: এরপর কোনটি?
: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।
: এরপর?
: মাবরুর হজ! Ñহাদীস ১৫১৯
ক্ষেত্রবিশেষে হজ ফজিলতের বিবেচনায় জিহাদের চেয়েও এগিয়ে যায়। একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি তো অমুক জিহাদে নাম লিখিয়েছি আর আমার স্ত্রী হজ করতে যাচ্ছে! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন : তুমি চলে যাও, তার সঙ্গে গিয়ে হজ পালন করো। Ñমুসনাদে আহমদ, হাদীস ৩২৩১
আর নারীদের জন্যে তো হজকেই বলা হয়েছে শ্রেষ্ঠ জিহাদ। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি একবার বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা তো জিহাদকেই শ্রেষ্ঠ আমল মনে করে থাকি। তাহলে আমরা কি জিহাদ করব না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন :
لاَ لَكِنَّ أَفْضَلَ الْجِهَادِ حَجٌّ مَبْرُورٌ
না, বরং শ্রেষ্ঠ জিহাদ তো মাবরুর হজ! Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২০

নিষ্পাপ জীবন আর জান্নাতের অঙ্গীকার

হজের মাধ্যমে গোনাহ মাফ হয়⸺এ মর্মে একটি হাদীস আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি আরও জোরালোভাবে বলেছেন :
مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে হজ আদায় করে, এরপর সে কোনো অশ্লীল কাজ ও পাপাচারে না জড়ায়, তাহলে সে এক সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো (নিষ্পাপ হয়ে) বাড়িতে ফিরে আসে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২১
এ সবকিছুর চেয়ে বড় বিষয়⸺হজ একটি প্রেমসিক্ত ইবাদত। যে প্রেমের আহ্বানে বান্দা ছুটে যায় দূর আরবের মক্কা নগরীতে, সেই প্রেম নিয়ে যদি ফিরে আসা যায় হজ শেষে নিজের দেশে, এ হজ তাহলে সফল। বিষয়টি যেমন সহজ নয়, তাই এর পুরস্কারও ছোট নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন :
الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا، وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ
এক উমরার পর আরেক উমরা এ দুয়ের মধ্যবর্তী গোনাহগুলো মিটিয়ে দেয়, আর মাবরুর হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৭৭৩

Comments

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    - আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

    সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
    ক্যাটাগরি সমূহ
    ট্যাগ সমূহ
    error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ