Post Updated at 23 Sep, 2024 – 8:52 PM
প্রতিযোগিতা বা অন্যকে পিছনে ফেলে নিজে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা মানুষের মজ্জাগত। জীবনের নানা ক্ষেত্রেই মানুষ কখনো সচেতনভাবে কখনো অবচেতনভাবে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। প্রতিযোগিতার মাঠে কেউ যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণই সে সামনে এগুতে থাকে। স্বাভাবিক কথা, এর ভালো-মন্দ নির্ণীত হবে বিষয় ও ক্ষেত্র দিয়ে। কাজ যদি ভালো হয়, এর প্রতিযোগিতাও ভালো হবে। আর মন্দ কাজের প্রতিযোগিতাও মন্দই হবে। ইসলামি শরিয়তও ভালো প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করেছে। এই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া প্রতিযোগীর প্রশংসা করেছে।
নেক কাজে প্রতিযোগিতায় কুরআনের নির্দেশনা
সূরা বাকারায় আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
সুতরাং তোমরা সৎকর্মে একে অন্যের অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা কর। [সূরা বাকারা: ১৪৮]
এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সৎ কাজে একে অপরের অগ্রগামী হওয়ার আদেশ করেছেন, নেক কাজে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
সূরা মুতাফফিফীনে পূণ্যবানদেরকে জান্নাতে যে পানীয় পান করানো হবে তার বিবরণ দেওয়ার পর আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَفِي ذَٰلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ
আর এরই জন্য প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক। [সূরা মুতাফফিফীন: ২৬]
এই আয়াতেও আল্লাহ তাআলা আদেশের ভঙ্গিতে নেক কাজে প্রতিযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। উক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তাআলা আদেশের মাধ্যমে নেক কাজে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার পর সেই প্রতিযোগিতা ভালো ও প্রশংসনীয় হওয়ার ব্যাপারে আর কোনও সংশয়ে থাকার সুযোগ নেই। এবং সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া প্রতিযোগীর পরিণাম ভালো হওয়ার বিষয়টিও সুনিশ্চিত হয়ে যায়।
নেক কাজে প্রতিযোগিতায় হাদীসের নির্দেশনা
এমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একাধিক হাদীসে নেক কাজে প্রতিযোগিতা করার কথা ব্যক্ত হয়েছে। আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لَوْ يعْلمُ النَّاسُ مَا في النِّداءِ والصَّفِّ الأَولِ ثُمَّ لَمْ يَجِدُوا إِلاَّ أَنْ يسْتَهِموا علَيهِ لاسْتهموا علَيْهِ، ولوْ يعْلَمُونَ مَا فِي التَّهْجِير لاسْتبَقوا إَليْهِ، ولَوْ يعْلَمُون مَا فِي العَتَمَةِ والصُّبْحِ لأتوهمُا ولَوْ حبوًا.
আযানে ও প্রথম কাতারে কী ফযীলত রয়েছে তা যদি মানুষ জানত, আর লটারী ব্যতীত এ সুযোগ লাভ করা সম্ভব না হত তাহলে অবশ্যই তারা লটারী করত। নামাজে শরিক হওয়ার জন্যে আগেভাগে যাওয়ার যে ফযীলত, যদি তারা তা জানত তাহলে এর জন্য তারা প্রতিযোগিতা করত। আর এশা ও ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করার কী ফযীলত তা যদি তারা জানত তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দুই ওয়াক্তে তারা জামাতে উপস্থিত হত।
– সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৬৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৪৩৭
এই হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি ভালো কাজের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সে কাজগুলোর ফযীলত ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে মানুষের জানা থাকলে তা লাভের জন্য মানুষ একে অপরের সাথে কী পরিমাণ প্রতিযোগিতা করত- তা বিভিন্নভাবে চিত্রিত করেছেন। ব্যাপকার্থে হাদীসটি থেকে আমরা সকল প্রকার নেক ও ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করার উৎসাহ পাই।
নেক কাজে প্রতিযোগিতায় সাহাবায়ে কেরাম রাযি.
শরিয়ত থেকে আমরা যে নির্দেশনা পাই সাহাবায়ে কেরাম রাযি. ছিলেন তা বাস্তবায়নের উত্তম নুমনা, সমুজ্জ্বল আদর্শ। তারই ধারাবাহিকতায় এ বিষয়টিও তাদের জীবনে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিটি ভালো কাজে তারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন, একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টার কোনও কমতি করতেন না। হাদীস ও আছারের বিভিন্ন জায়গায় এরকম বহু ঘটনা জ্বলজ্বল করছে, যা থেকে আমরা আলো গ্রহণ করতে পারি প্রতিনিয়ত।
একটি ঘটনা। হযরত আসলাম রাযি. বর্ণনা করেন, আমি ওমরকে বলতে শুনেছি যে- একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দান করার আদেশ করলেন। তখন আমার হাতে সম্পদ ছিল। আমি মনে মনে ভাবলাম: দানের ক্ষেত্রে আবু বকরকে যদি কোনোদিন ছাড়িয়ে যেতে পারি তাহলে তার এখনই সময়, আজ আমি আবু বকরকে ছাড়িয়ে যাব। তখন আমি আমার সম্পদের অর্ধেকটাই নিয়ে আসলাম। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন: তুমি তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? আমি বললাম: এর সমপরিমাণ। আর আবু বকর তার কাছে সম্পদ বলতে যা ছিল তার পুরোটাই নিয়ে আসল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন: আবু বকর, তুমি তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তরে বললেন: আমি আল্লাহ ও তার রাসূলকে তাদের জন্য রেখে এসেছি (আর বাকি সবই নিয়ে এসেছি)। ওমর রাযি. বলেন: তখন আমি মনে মনে বললাম: আর কখনই আমি কোনো ক্ষেত্রে আবু বকরকে ছাড়িয়ে যেতে পারব না (যেহেতু আমার হাতে সম্পদ থাকার পরও তিনিই আমার চেয়ে অগ্রগামী রইলেন)। [তিরমিযী, হাদীস: ৩৬৭৫; আবু দাউদ, হাদীস: ১৬৭৮]
আরেকটি ঘটনা হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব রাযি. এর। উহুদ যুদ্ধের আগে অন্যান্য সাহাবীদের মত সামুরা ইবনে জুনদুব ও রাফে ইবনে খদীজও শাহাদাতের তামান্নায় জিহাদে অংশগ্রহণের প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু বয়সের স্বল্পতার কারণে মুজাহিদদের বাছাইপর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উভয়কেই ফিরিয়ে দেন। তখন রাফে ইবনে খদীজ এর বাবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমার ছেলে রাফে ভালো তীরন্দাজ, আপনি তাকে অনুমতি দিতে পারেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাফে রাযি.কে অনুমতি দিলেন। আর তখনই সামুরা ইবনে জুনদুব রাযি. অভিমানের সুরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলে উঠলেন: রাসূল, আপনি রাফেকে অনুমতি দিলেন আর আমাকে অনুমতি দিলেন না! অথচ আমি যদি তার সাথে কুস্তি লড়ি তাহলে অবশ্যই তাকে ধরাশায়ী করে ছাড়ব। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ঠিক আছে, তোমরা দুজন কুস্তি লড়ো। তখন সত্যি সত্যিই রাফে রাযি. সামুরা রাযি.কে ধরাশায়ী করে ফেললেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও অনুমতি দিলেন। [আল মুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস: ৬৭৪৯]
সাহাবায়ে কেরাম রাযি. নেক কাজে কতটা প্রতিযোগিতা করতেন, ত্যাগ ও বিসর্জনে কেমন করে সদা প্রস্তুত থাকতেন, তার উজ্জল নমুনা আমরা এই ঘটনা দুটি থেকেই আন্দাজ করতে পারি। একইসাথে উত্তম কাজে অগ্রগামী থাকার সকল সুযোগ কাজে লাগানোর ব্যাপারে তারা কী পরিমাণ সজাগ ও সচেতন থাকতেন তারও প্রমাণ মেলে এ ঘটনাদ্বয়ে।
ইসলামি শরিয়তের নির্দেশনা এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনে তার বাস্তবায়ন থেকে এ শিক্ষা আমরা গ্রহণ করতেই পারি—কী ব্যক্তি জীবন, কী সমাজজীবন, সর্বক্ষেত্রেই আমরা নেক ও কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করে যাব। এতে আমাদের নেককাজ বৃদ্ধি পাবে, নিজের জীবন সমৃদ্ধ হবে, দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। সমাজ হবে সুন্দর, অধিক সুন্দর।
[লেখাটি প্রস্তুত করেছেন মাওলানা সাকিব মাহমুদ, শিক্ষক, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা]
Comments (3)
মোঃ আবুল বাশারsays:
September 20, 2024 at 12:25 AMসুন্দর মাশাল্লাহ
Suhada Akthersays:
September 21, 2024 at 6:56 PMমাশাআল্লাহ
Mohammad Shirazul Islamsays:
September 23, 2024 at 6:08 AMমাশা-আল্লাহ