Press ESC to close

তালাক প্রসঙ্গে সামান্য অজ্ঞতার অসামান্য পরিণতি

Post Updated at 3 Dec, 2024 – 10:26 PM

তালাক মানবসংসারের এক অনুপেক্ষ অনুষঙ্গ। শান্তির জন্যে, জীবনকে পূর্ণতার পথে এগিয়ে নেয়ার জন্যেই মানুষ আবদ্ধ হয় বিয়ের বন্ধনে। অপরিচিত এক ছেলে আর এক মেয়ের মধ্যে গড়ে ওঠে দৃঢ় এক বন্ধন। এ বন্ধন এ জীবনদুটিকে এতটাই প্রভাবিত করে যে, এর ভিত্তিতে মেয়ে তার চিরচেনা আপন পরিবেশকে ‘পর’ করে দিয়ে অচেনা এক পরিবেশকে আপন করে নেয়। আর ছেলে নিজের জীবন-যৌবন সবকিছু তার নতুন সঙ্গীনির জন্যে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।

প্রতিটি মানবজীবনের জন্যেই এ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু এও এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা—জীবনকে স্থির ও শান্তিময় করে তোলার জন্যে যে বিয়ের আয়োজন, সে বিয়েই মাঝেমধ্যে জীবনকে বিষিয়ে তোলে, অস্থিরতা ও অশান্তি ছড়িয়ে দেয় জীবনের প্রতিটি পরতে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়ে বিচ্ছেদের, পা বাড়াতে হয় তালাকের পথে। কখনো আবার পারিপার্শ্বিক কোনো কারণেও তালাকের আশ্রয় নিতে হয়।

তালাক প্রসঙ্গে আরেকটি বাস্তবতা এমনও যে, এ প্রসঙ্গে অজ্ঞতার কারণে বিভিন্ন রকম ভুল হয়ে থাকে। তালাক কখন দেবে, কীভাবে দেবে, কত তালাক দেবে ইত্যাদি নানা দিক থেকে ভুল প্রয়োগ হয় তালাকের। এ অজ্ঞতার পরিমাণ খুব বেশি নয়। দু-চারটি কথা জেনে নিলেই হলো। কিন্তু এ সামান্য অজ্ঞতার কারণে যখন তালাকের ভুল প্রয়োগ হয়, তখন সে ভুলের পরিণতি হয় ভয়াবহ, অসামান্য।

পবিত্র কুরআনে কারীমে যেসব বিষয়ে বিস্তারিত বিধানাবলি বর্ণিত হয়েছে, তালাক সেসবের অন্যতম। তালাক কখন দিতে হবে, কয় তালাক দেবে, কীভাবে তালাক দেবে, তালাক দেয়ার আগে কী কী ধাপ পেরিয়ে আসতে হবে, তালাক দেয়ার পর করণীয় কী—এসবই বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে পাক কুরআনে। লক্ষ করুন—

اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوْنَ عَلَی النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰهُ بَعْضَهُمْ عَلٰی بَعْضٍ وَّ بِمَاۤ اَنْفَقُوْا مِنْ اَمْوَالِهِمْ ؕ فَالصّٰلِحٰتُ قٰنِتٰتٌ حٰفِظٰتٌ لِّلْغَیْبِ بِمَا حَفِظَ اللّٰهُ ؕ وَ الّٰتِیْ تَخَافُوْنَ نُشُوْزَهُنَّ فَعِظُوْهُنَّ وَ اهْجُرُوْهُنَّ فِی الْمَضَاجِعِ وَ اضْرِبُوْهُنَّ ۚ فَاِنْ اَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوْا عَلَیْهِنَّ سَبِیْلًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَلِیًّا كَبِیْرًا ۝۳۴ وَ اِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَیْنِهِمَا فَابْعَثُوْا حَكَمًا مِّنْ اَهْلِهٖ وَ حَكَمًا مِّنْ اَهْلِهَا ۚ اِنْ یُّرِیْدَاۤ اِصْلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰهُ بَیْنَهُمَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَلِیْمًا خَبِیْرًا ۝۳۵

পুরুষেরা নারীদের ওপর কর্র্র্তৃত্বশীল, কেননা আল্লাহ তাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে। যারা নেককার নারী, তারা অনুগতা, আল্লাহর সংরক্ষণের মাধ্যমে সে গোপন বিষয়াদির সংরক্ষিকা। তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদেরকে উপদেশ দাও, তাদের বিছানা পৃথক করে দাও এবং তাদের প্রহার করো। এতে যদি তারা তোমাদের কথা মেনে চলে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ তালাশ করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বোচ্চ, মহান। আর যদি তোমরা তাদের দুইজনের মধ্যে বিরোধের আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন শালিশ নিযুক্ত করো। এরা দুজন যদি সমঝোতা চায় তবে আল্লাহ তাদের দুজনের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত। – সূরা নিসা (৪) : ৩৪-৩৫

সংসারে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দেশ করার পর এ আয়াতে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পাশে থাকবে—সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায়, এটাই তো স্বাভাবিক। স্বামী নিজ কাঁধে তুলে নেবে স্ত্রীর ভার আর স্ত্রী থাকবে স্বামীর অনুগত, স্বামীর অনুপস্থিতিতে রক্ষণাবেক্ষণ করবে স্বামীর সংসার, নিজের সতীত্বসহ সবকিছু। কিন্তু কখনো যদি স্ত্রী এড়িয়ে চলতে চায় স্বামীকে, তার কথা না শোনে, শরিয়তের বিধানাবলি তোয়াক্কা না করে, তখনই সৃষ্টি হয় মনোমালিন্য, এরপর ঝগড়া ও দূরত্ব। অনাকাঙ্খিত এমন পরিস্থিতিতে অনেকে শুরুতেই প্রয়োগ করে তালাকের বিষ। তাও এক-দুই তালাক নয়, সরাসরি তিন তালাক! এমনকি সঙ্গে বায়েন তালাকও! ফলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, ভেঙে যায় সাজানো সংসার।

কুরআনের উপরোক্ত আয়াতে আমাদেরকে এ নির্দেশনাই দেয়া হচ্ছে—সম্পর্কের অবনতি হলেই তালাক নয়। বরং যদি কোনো নারীর অবাধ্যতার আশঙ্কা হয়, তবে প্রথমে তাকে বোঝাতে হবে, সুন্দর ভাষায়, সদুপদেশ দিয়ে। হতে পারে, এতটুকুতেই স্ত্রী নিজের ভুল বুঝতে পারবে এবং আবারও অনুগত হয়ে চলতে শুরু করবে। আর যদি এতে কাজ না হয়, তবে তার সঙ্গে এক বিছানায় থাকা বর্জন করতে হবে। তার বিছানা পৃথক করে দিতে হবে। এতে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে স্ত্রীর মনে থাকা যাবতীয় মান-অভিমান। স্বামীর প্রতি অনুগত মন নিয়ে আবারও সে অলঙ্কৃত করতে পারে রাণীর সিংহাসন।

কিন্তু যদি এতেও কাজ না হয়, অবাধ্যতার পথে সে থাকে অটল অবিচল, তখন শেষ চেষ্টা—শাসন। মৃদু আঘাতে স্বামী স্ত্রীকে হালকা শাসন করবে। প্রহার হবে সর্বোচ্চ এতটুকু, যেন শরীরের চামড়া কেটে বা ফেটে না যায়, হাড় যেন ভেঙে না যায়, আর চেহারায় কোনো আঘাত করা যাবে না। এভাবে একটু শাসন করবে। এ শেষ ধাপে এসেও যদি স্ত্রীর ভুল ভাঙে, সে সঠিক পথে ফিরে আসে, তবে আর তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না, তার নামে কোনো অভিযোগ করা যাবে না, তাকে নতুন করে আর শাসন করা যাবে না।

যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিরোধ কিছুতেই না মিটে, সদুপদেশ দান, বিছানা পৃথক করা আর হালকা প্রহারের পরও যদি স্ত্রী স্বামীর অনুগত না হয়, তবে তো তালাকের দিকে এগুতেই হবে। কিন্তু তাও এখনই নয়। তালাক দিলে তো সম্পর্ক ছিন্ন হয়েই গেল। জোড়া একটি সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে শেষ আরেকটি পদক্ষেপ এবং এটি পারিবারিক। দুই পরিবারের দায়িত্বশীল দুজন ব্যক্তি তাদের বিষয় নিয়ে ভাববে, তাদেরকে মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। এ চেষ্টাও যদি ব্যর্থ হয়, তবে তারাই তালাকের সিদ্ধান্ত জানাবে।

এটাই আমাদের প্রতি শরিয়তের নির্দেশনা। তালাক যদি দিতেই হয়, তবে এর আগে উপরোক্ত ধাপগুলো পেরিয়ে আসতে হবে। সামান্য মান-অভিমানে কিংবা একটু ঝগড়াতেই হুট করে তালাক নয়। তালাক প্রসঙ্গে শরিয়তের সিদ্ধান্ত তো এমন—তালাক যেভাবেই দেয়া হোক, ভেবেচিন্তে কিংবা মজাচ্ছলে হাসিকৌতুক করে, খামখেয়ালি করে, ঝগড়া করে, রাগ করে, কিংবা কাজী অফিসে বসে, লিখিত বা মৌখিক যেভাবেই হোক, তালাক কার্যকর হয়ে যাবে।

তালাক কার্যকর হওয়ার জন্যে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাক্ষীও লাগে না এবং স্ত্রীকে শুনিয়েও তালাক দিতে হয় না। বিয়ের পর স্বামী তালাকের অধিকার বা সুযোগ লাভ করে। এ অধিকার একবার কাজে লাগিয়ে ফেললে তা আর প্রত্যাহার করার সুযোগ থাকে না; বরং তালাক কার্যকর হয়ে যায়। এ জন্যেই শরিয়ত আমাদেরকে নির্দেশ করছে একবার তালাক দেয়ার আগে শতবার ভেবে দেখার, তালাক প্রয়োগ করার আগে অন্য যত চেষ্টা আছে সব প্রয়োগ করার। যদি কোনোটাতেই কাজ না হয়, তবেই তালাক, এর আগে নয়।

তালাক দিতে হলে কয় তালাক দেবে—এ বিষয়েও ইসলামের নির্দেশনা সুস্পষ্ট এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ। তালাক যদি দিতেই হয়, কেবল এক তালাক দেবে। তাও এমনভাবে, যেন রাজাআত বা ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে। তালাক দেয়ার পর প্রায় সকলেই আবার আগের স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করতে চায়। এটা মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতা। আবার স্ত্রীর পক্ষ থেকেও তালাক ফিরিয়ে নেয়ার আব্দার আসতে পারে। তালাক প্রয়োগের পর স্ত্রী হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পারবে, সঠিক পথে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা লাভ করবে। সে সুযোগটিও রাখা হয়েছে।

আর যদি তালাক প্রত্যাহারের প্রয়োজন না হয়, তবে আর কিছুই করতে হবে না। এভাবেই যখন তালাক পরবর্তী ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে, তখন এ রাজঈ তালাকই বায়েন তালাক হয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়েই আগের বিয়ের সম্পর্কটি সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হবে। একবার তালাক ফিরিয়ে নেয়ার পর স্ত্রী যদি আবারও আগের ভুল পথে ফিরে যায়, তবে আরও একবার আগের মতোই তালাক দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা দ্বিতীয় তালাক এবং রাজঈ তালাক। এতেও রয়েছে তালাক প্রত্যাহার করে আবারও সংসার করার সুযোগ। আর প্রত্যাহার যদি করা না হয়, তবে ইদ্দত শেষে তালাকে বায়েন হয়ে যাবে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনে এ নির্দেশনাটি এসেছে এভাবে—

اَلطَّلَاقُ مَرَّتٰنِ ۪ فَاِمْسَاكٌۢ بِمَعْرُوْفٍ اَوْ تَسْرِیْحٌۢ بِاِحْسَانٍ

তালাক দুইবার। এরপর হয়তো ন্যায়সঙ্গতভাবে রেখে দেয়া কিংবা সুন্দরভাবে বিদায় দেয়া। – সূরা বাকারা (২) : ২২৯

বলাবাহুল্য, এখানে রাজঈ তালাকের কথা বলা হয়েছে। এজন্যেই তালাক দেয়ার পরও আবার স্ত্রীকে রেখে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তালাক দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে দুইবার। অর্থাৎ একটি করে দুইবারে দুই তালাক দেয়া যাবে। এর বেশি নয়। যদি কেউ তৃতীয় তালাকটি দিয়ে দেয়, তবে এ স্ত্রীকে নিয়ে তার আর সংসার করার সুযোগ থাকে না। পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা—

فَاِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهٗ مِنْۢ بَعْدُ حَتّٰی تَنْكِحَ زَوْجًا غَیْرَهٗ ؕ فَاِنْ طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَیْهِمَاۤ اَنْ یَّتَرَاجَعَاۤ اِنْ ظَنَّاۤ اَنْ یُّقِیْمَا حُدُوْدَ اللّٰهِ ؕ وَ تِلْكَ حُدُوْدُ اللّٰهِ یُبَیِّنُهَا لِقَوْمٍ یَّعْلَمُوْنَ ۝۲۳۰

এরপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে স্ত্রী আর স্বামীর জন্যে বৈধ হবে না, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কোনো স্বামীকে বিয়ে করে। এরপর যদি (পরবর্তী) স্বামী তাকে তালাক দেয়, তখন তারা (অর্থাৎ প্রথম স্বামী ও স্ত্রী) আবার একে অন্যের কাছে ফিরে আসাতে কোনো গোনাহ হবে না, যদি তারা ধারণা করে—তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করতে পারবে। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা, তিনি তা এমন সম্প্রদায়ের জন্যে বর্ণনা করেন, যারা জানে। – সূরা বাকারা (২) : ২৩০

এভাবেই ইসলামি শরিয়তে একে একে তিনটি তালাককে বৈধ করা হয়েছে। প্রথম দুটি যদি রাজঈ তালাক হয় তবে ইদ্দতের মধ্যে সহজেই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়া যাবে। ফিরিয়ে না নিলে এ রাজঈ তালাকই ইদ্দত শেষে বায়েন তালাক হয়ে যাবে। এমনকি যদি প্রথমেই একবার বা দুইবার বায়েন তালাক দেয়া হয়, তবুও সুযোগ থাকবে এ স্বামী-স্ত্রী আবারও সংসারে একত্রিত হওয়ার। তবে তখন রাজাআত বা ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকবে না, বরং বিয়ে নবায়ন করতে হবে, নতুন মোহর ও সাক্ষীসহ। এটা ইদ্দতের মধ্যেও হতে পারে, ইদ্দত শেষ হওয়ার পরও হতে পারে।

রাজঈ তালাক দেয়ার পর যদি তা প্রত্যাহার করা না হয় এবং এজন্যে তা ইদ্দত শেষে বায়েন হয়ে যায়, এরপরও বিয়ে নবায়নের মাধ্যমে তাদের আবারও সংসার করার সুযোগ থাকবে। শরিয়তের শিক্ষা ও নির্দেশনা হলো—তালাক যদি দিতেই হয় তো দাও, তবে শুরুতেই সব পথ বন্ধ করে নয়। আবারও আগের সংসারে ফিরে যাওয়া যায়, ভুলত্রুটি ভুলে গিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করা যায়—এ সুযোগটি হাতে রেখে তালাক দাও। আর এ জন্যে একটাই পথ—একসঙ্গে তিন তালাক না দেয়া। একসঙ্গে তিন তালাকের কথা মুখ থেকে বেরিয়ে গেলে আর কোনো সুযোগই থাকে না।

এ বিষয়টি আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষেরা তো একেবারেই জানে না। তারা মনে করে, তালাক দিতে হলে এভাবেই দিতে হয়—এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বায়েন তালাক! দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজের অনেক কাজী, যারা সরকারি নিয়মে বিবাহ ও তালাক নথিভুক্ত করে থাকেন, তারাও জানেন না। পারিবারিক অশান্তিতে জর্জরিত হয়ে তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন কেউ তাদের কাছে যায় এবং তালাকের বিষয়টি তাদের হাতে অর্পণ করে, তখন তারাও একসঙ্গে এ তিন তালাক প্রয়োগ করে।

এমন ঘটনা আমাদের সমাজে একটি-দুটি নয়, অজস্র। এরপর যখন রাগ দমে যায়, কিংবা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, অথবা স্ত্রী কাকুতিমিনতি করে, তখন আবারও সংসার করতে চায় ঠিক। কিন্তু তখন শরিয়তের দৃষ্টিতে তার সামনে আর কোনো সুযোগ থাকে না। সে তখন নিষিদ্ধ হিলার পথে হাঁটে কিংবা শরিয়তের বিধানকে উপেক্ষা করে।

হিলা যদি নিয়মমাফিক হয়, তবে এতে তার স্ত্রী তার জন্যে হালাল হয়ে যাবে ঠিক, কিন্তু এ হিলা তো শরিয়তে অভিশপ্ত এক কাজ। হিলা করার জন্যে যার কাছে বিয়ে দেয়া হবে, তাকে তুলনা করা হয়েছে ভাড়া করা ষাড়ের সঙ্গে। আর যদি মান-সম্মান, চক্ষুলজ্জা কিংবা অন্য কোনো কারণে সোজা শরিয়তের বিধানকেই উপেক্ষা করে এবং তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সংসার চালিয়ে যায়, তবে এতে খুলে যায় যিনা-ব্যভিচারের দুয়ার। সামান্য একটু অসতর্কতা ও অজ্ঞতার কারণে দুটি জীবন এভাবেই অনিঃশেষ হারামে জড়িয়ে পড়ে।

ইসলামি ফিকহের পরিভাষায়, একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া হলে তাকে বলা হয় ‘আততালাকুল বিদঈ’ বা বিদআতী তালাক। এটা নিষিদ্ধ। তালাক দিতে হলে উপরোক্ত বিধান অনুসারে দিতে হবে। ভেবেচিন্তে দেবে, হুট করে নয়, রাগ করেও নয়। এমনকি হাদীসে তো এ কথাও বলা হয়েছে—তালাক স্ত্রীর অপবিত্র অবস্থায় দেবে না এবং এমন পবিত্র অবস্থায়ও নয়, যে পবিত্রতায় তার সঙ্গে শারীরিক মেলামেশা হয়েছে। এসব বিধান মেনে যদি তালাক দেয়া হয়, তালাক দেয়ার আগে যদি এর পূর্ববর্তী ধাপগুলো মেনে চলা হয়, তবে সে তালাক কোনো সংকটের কারণ হবে না। বরং তালাক হবে আগের জীবনের ভুল শোধরানোর সুযোগ কিংবা উভয়ের জন্যেই নতুন করে অন্য কারও সঙ্গে সংসারের ভূমিকা।

সামান্য ঝগড়াতেই তালাক নয় এবং ‘তালাক মানেই তিন তালাক নয়’—তালাক প্রসঙ্গে এতটুকু ইলমও যদি আমাদের ব্যাপকভাবে থাকত, তবে আমাদের সমাজের চিত্রটা ভিন্ন হতো। সেখানে হিল্লা বিয়ের কোনো প্রয়োজনই হতো না। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালিয়ে যাওয়ার মতো হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহসও কাউকে দেখাতে হতো না। সমাজের যারা কর্তাব্যক্তি কিংবা দীনি অভিভাবক, তাদের কাছে এসে কাউকে সন্তানের দোহাই দিয়ে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করার পথও তালাশ করতে হতো না। এ জন্যে প্রয়োজন—একটু সচেতনতা, আম-খাস সকল মুসলমানের। সামান্য এ সচেতনতাই আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে অসামান্য পরিণতি থেকে।

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

উসতাযুল হাদীস, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া ঢাকা, মোহাম্মদপুর। মাসিক আলকাউসারসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। তাঁর লিখিত বইও পাঠক মহলে নন্দিত হয়েছে। তিনি মুসলিমস ডে অ্যাপের শরয়ী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাইট হিট কাউন্টার

সর্বমোট পোস্ট ভিউ: ১,৯৬৮,১০৪

পোস্ট কপি করার অপশন বন্ধ রাখা হয়েছে। অনুগ্রহ করে পোস্টের লিংক কপি করুন