Post Updated at 30 Oct, 2024 – 8:20 AM
সফলতা কে না চায়? এটি এমন এক শব্দ যার পেছনে প্রতিনিয়ত ছুটে চলছে পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ। সকল শ্রেণি-পেশার প্রত্যেকটা মানুষই নিজ অবস্থানে সফল হতে চায় এবং সে লক্ষ্যে চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
আমাদের আসল পরিচয়―আমরা মুমিন। প্রত্যেক মুমিনের দিলের তামান্না থাকা উচিত―মুমিন হিসেবে সফল হতে চাওয়া এবং সে লক্ষ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা; মুমিন হিসেবে সফল হতে হলে- কী করতে হবে আর কী করা যাবে না তা জেনে নিয়ে সে মোতাবেক নিজের জীবন পরিচালনা করা।
এ কাজটি আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য খুব সহজ করে দিয়েছেন। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সফল মুমিনের গুণাবলি আলোচনা করেছেন। সূরা মুমিনূনের প্রথমাংশটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে আল্লাহ তাআলা সর্বোমোট ছয়টি গুণের আলোচনা করেছেন। গুণাবলি উল্লেখের পূর্বে প্রথম আয়াতেই আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়েছেন―
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ
অর্থ : (এ সমস্ত গুণের অধিকারী) মুমিনগণ অবশ্যই সফল। [সূরা মুমিনূন : ১]
আমাদের আজকের আলোচনা এ ছয়টি গুণ নিয়েই।
১. নামাজে বিনয়াবনত হওয়া
সফল মুমিনের প্রথম গুণ হিসেবে আল্লাহ তাআলা বলেন:
الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ
অর্থ : যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত। [সূরা মুমিনূন : ২]
পরিপূর্ণ সফলতা অর্জনকারী মুমিনের সর্বপ্রথম যে গুণটির কথা আল্লাহ আলোচনা করেছেন তা হচ্ছে―নামাযে বিনয়াবনত হওয়া। নামাযে বিনয়াবনত হওয়া বা খুশু’র সাথে নামায পড়ার অর্থ হচ্ছে―নিজের অন্তরকে নামাযে উপস্থিত রাখা। আল্লাহর কাছে সঁপে দেওয়া। শান্ত-স্থির রাখা। নামাযে যা তেলাওয়াত করা হচ্ছে, যে দুআ-দরুদ পড়া হচ্ছে তার প্রতি মনোযোগী হওয়া। আর যখন অন্তর হবে স্থির-শান্ত, আল্লাহর প্রতি সমর্পিত, তখন তার প্রভাব নামাযীর বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপরও পড়বে। তখন নামাযী মাথা অবনত রাখবে। তার দৃষ্টি থাকবে নিম্নমুখী। আদবের সাথে দাঁড়াবে। এদিক-সেদিক তাকাবে না। গায়ের কাপড় বা দাড়ি ইত্যাদি নিয়ে অনর্থক নাড়াচাড়া করবে না। আঙুল মটকাবে না। যেসব কাজ আল্লাহভীতি ও আদব-পরিপন্থী তা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। নামাযের শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত। যদি কখনও অনিচ্ছাকৃতভাবে এর বিপরীত কিছু ঘটে যায় তাহলে স্মরণ হওয়া মাত্র এগুলোর প্রতি মনোযোগী হবে।
নামায সহি হওয়ার জন্য খুশু শর্ত না হলেও আল্লাহ তাআলার দরবারে উত্তমরুপে কবুল হওয়ার জন্য খুশু বা নামাযে বিনয়াবনত হওয়া অন্যতম শর্ত।
নামাযে বিনয়াবনত হওয়ার গুরুত্ব কতটুকু, তা ফুটে উঠেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একাধিক হাদীসে। তিনি বলেন : আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি মনোযোগী থাকেন যতক্ষণ না সে এদিক-সেদিক মুখ ঘুরায়। যখন বান্দা এদিক-সেদিক মুখ ঘুরায় তখন আল্লাহও তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। [মুশকিলুল আছার, হাদীস ১৪২৮]
নামাযে বিনয়াবত না হলে সেক্ষেত্রে কঠোর ধমক উচ্চারিত হয়েছে হাদীসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলেন : লোকদের কী হল! তারা নামাযে আকাশের দিকে তাকায়। হয়তো তারা এ থেকে বিরত হবে, নয়তো তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেয়া হবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫০]
অপরদিকে নামাযে অলসতা করাকে মুনাফিকের নামাযের অবস্থা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কুরআনুল কারীমে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللّٰهَ وَ هُوَ خَادِعُهُمْ ۚ وَ اِذَا قَامُوْۤا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا كُسَالٰی ۙ یُرَآءُوْنَ النَّاسَ وَ لَا یَذْكُرُوْنَ اللّٰهَ اِلَّا قَلِیْلًا
অর্থ : নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করে। আর তিনিও তাদেরকে এর শাস্তি দিয়ে থাকেন। তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন নামাযে দাঁড়ায় অলসভঙ্গিতে, কেবল লোক দেখানোর জন্য। তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে থাকে। [সূরা নিসা : ১৪২]
২. অনর্থক কথা-কাজ থেকে বিরত থাকা
এটি সফল মুমিনের দ্বিতীয় গুণ। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ
অর্থ : যারা অনর্থক বিষয় থেকে বিরত থাকে। [সূরা মুমিনূন : ৩]
সফল মুমিন অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে। অর্থাৎ অযথা ও অর্থহীন কাজকর্মে তারা সময় নষ্ট করে না। তারা বরং আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকে। এমনকি তারা যখন অনর্থক কাজে লিপ্ত কারও পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন ভদ্রতার সাথে সেখান থেকে সরে পড়ে। যেমনটি বলা হয়েছে কুরআনের অন্যত্র, যেখানে আলোচনা করা হয়েছে করুণাময় আল্লাহ তাআলার প্রকৃত বান্দাদের বৈশিষ্ট্যাবলি সম্পর্কে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَ اِذَا مَرُّوْا بِاللَّغْوِ مَرُّوْا كِرَامًا
অর্থ : যখন তারা (আল্লাহর প্রকৃত বান্দারা) অনর্থক বিষয়ের পাশ দিয়ে যায় তখন ভদ্রভাবে চলে যায়। [সূরা ফুরকান: ৭২]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম অনর্থক বিষয় থেকে দূরে থাকাকে মুমিনের সৌন্দর্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন : ‘অর্থহীন বিষয়াদি বর্জন করা একজন মুসলিমের অন্যতম সৌন্দর্য।’ [তিরমিযী, হাদীস ২৩১৭]
অনর্থক বিষয়াদি থেকে বেঁচে থাকার সহজ পদ্ধতি হচ্ছে―সর্বদা অযথা কথা থেকে বিরত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কেউ যখন অযথা কথা থেকে পরিপূর্ণ বিরত থাকতে পারবে তখন তার জন্য অযথা কাজ থেকেও বিরত থাকা সহজ হয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম হযরত মুআয রাযি.কে এ উপদেশ দিয়েছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম তাকে বলেছিলেন : আমি কি তোমাকে সবকিছুর মূল সম্পর্কে বলে দেব না? মুআয রাযি. বললেন : অবশ্যই বলে দিন হে আল্লাহর রাসূল। তখন তিনি নিজ জিহ্বা ধরে বললেন : তোমার এই জিহ্বাকে সংযত রাখো।
-হে আল্লাহর রাসূল, আমরা যে সমস্ত কথা বলি, তার কারণেও কি আমাদের পাকড়াও করা হবে?
-তোমার মা সন্তানহারা হোক! মানুষকে তো জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে তাদের জিহ্বার কামাই-ই। [তিরমিযী, হাদীস ২৬১৬]
হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহ্বাকে সকল কিছুর মূল সাব্যস্ত করলেন। মানুষ যেসব কারণে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে যবানের অপব্যবহার তার অন্যতম। সুতরাং যে তার জিহ্বাকে অযথা-অনর্থক কথা থেকে বিরত রাখতে পারবে, তার জন্য অনর্থক কাজ থেকেও বিরত থাকা সহজ হয়ে যাবে।
৩. যাকাত আদায় করা
সফল মুমিনের তৃতীয় গুণ হিসেবে আল্লাহ তাআলা যাকাত আদায়ের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন :
وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِلزَّكٰوةِ فٰعِلُوْنَ
অর্থ : যারা যাকাত আদায় করে। [সূরা মুমিনূন : ৪]
যাকাত ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোর একটি। যাকাত গরিবের হক। নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর বছরান্তে যাকাত আদায় করা ফরয। যে যাকাত আদায় করবে না তার জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা এসেছে ইসলামি শরিয়তে। যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, পাক পবিত্র করা। যাকাত ব্যক্তির সম্পদকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। তাই পরিভাষায় একে যাকাত বলা হয়।
মুফাসসিরগণের ভাষ্য হচ্ছে, এ আয়াতে আর্থিক যাকাত যেমন উদ্দেশ্য, তেমনি আত্মিক যাকাতও উদ্দেশ্য। আত্মিক যাকাত মানে আত্মিক পরিশুদ্ধি, তাযকিয়া। নিজেকে মন্দ কাজ ও মন্দ চরিত্র থেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ রাখা। কুরআনের অন্যত্র সফল মুমিনের বর্ণনায় অন্তর পরিশুদ্ধ রাখার ক্ষেত্রেও ‘যাকাত’ শব্দের ব্যবহার এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَا
অর্থ : সেই সফল যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করবে। আর ব্যর্থ সে যে তা ধ্বংস করবে। [সূরা শামস: ৯, ১০]
সুতরাং, আর্থিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি সফল মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৪. আপন লজ্জাস্থানের হেফাজত করা
আল্লাহ তাআলা সফল মুমিনের চতুর্থ গুণের বিবরণ দিয়েছেন পরবর্তী তিন আয়াতে, একটু বিশদভাবে। তিনি বলেন:
وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْنَ اِلَّا عَلٰۤی اَزْوَاجِهِمْ اَوْ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُهُمْ فَاِنَّهُمْ غَیْرُ مَلُوْمِیْنَ فَمَنِ ابْتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْعٰدُوْنَ
অর্থ : যারা নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে, নিজেদের স্ত্রী ও মালিকানাধীন দাসীদের ছাড়া অন্য সকলের থেকে। তারা (এ ক্ষেত্রে) অভিযুক্ত হবে না। তবে কেউ এ ছাড়া অন্য কিছু কামনা করলে তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। [সূরা মুমিনূন : ৫-৭]
সফল মুমিনের চতুর্থ গুণ―নিজ লজ্জাস্থানের হেফাজত করা। যৌন চাহিদা পূরণের জন্য কোনো অবৈধ পন্থা অবলম্বন না করা। আয়াতে দুটি বৈধ পন্থার বিবরণ এসেছে―নিজ স্ত্রী ও মালিকানাধীন দাসী। তবে বর্তমানে এ রকম দাসীর অস্তিত্ব কোথাও নেই। তাই বর্তমানে বৈধ পন্থা মাত্র একটি―স্ত্রী। স্ত্রীর সাথেও শরিয়ত অনুমোদিত পদ্ধতিতে মিলিত হতে হবে, অন্যথায় সেটাও অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। যারা কোনো অবৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা পূরণ করে তাদেরকে সীমালঙ্ঘনকারী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর হুকুমের সীমালঙ্ঘনকারী কখনোই সফল হতে পারে না।
আপন লজ্জাস্থানের হেফাজতের বিষয়ে নারী-পুরুষ সমান দায়িত্বশীল। লজ্জাস্থান হেফাজতের প্রথম ধাপ হচ্ছে নিজ দৃষ্টির হেফাজত করা। যে আপন দৃষ্টির হেফাজত করতে পারবে সে তার লজ্জাস্থানও হেফাজত করতে পারবে। কারণ, দৃষ্টির অন্যায় ব্যবহার লজ্জাস্থানের অন্যায় ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত করে। এজন্যই আল্লাহ তাআলা মুমিন নারী-পুরুষকে নিজ লজ্জাস্থানের পাশাপাশি দৃষ্টি হেফাজতের জোর আদেশ করেছেন। মুমিন পুরুষদের উদ্দেশ্যে বলেন:
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ یَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ یَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ؕ ذٰلِكَ اَزْكٰی لَهُمْ
অর্থ : (হে নবী,) তুমি মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য শুদ্ধতর। [সূরা নূর : ৩০]
আবার মুমিন নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন:
وَ قُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ یَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ
অর্থ : এবং মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। [সূরা নূর : ৩১]
৫. আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা
সফল মুমিনের পঞ্চম গুণ হচ্ছে, সে তার আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান ও সচেষ্ট। আমানতের খেয়ানত করে না এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِاَمٰنٰتِهِمْ وَ عَهْدِهِمْ رٰعُوْنَ
অর্থ : এবং যারা নিজেদের আমানতসমূহ ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান। [সূরা মুমিনূন : ৮]
এখানে ‘আমানত’ কথাটি অতি ব্যাপক। এর দ্বারা বান্দার প্রতি আরোপিত আল্লাহর আমানত যেমন বোঝানো হয়েছে, তেমনি মানুষের পারস্পরিক আমানতও বোঝানো হয়েছে। আল্লাহর আমানত বলতে বোঝায় ঈমান-আকীদা, ওহির ইলম, সৃষ্টিগত যোগ্যতা ইত্যাদি। বান্দার উচিত এগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করা এবং এ সম্পর্কিত যত আদেশ তা যথাযথভাবে পালন করা। মানুষের পারস্পরিক আমানত বলতে বোঝায় গচ্ছিত অর্থ-সম্পদ, প্রার্থিত রায় ও পরামর্শ, গোপন কথাবার্তা, অর্পিত পদমর্যাদা ও দায়দায়িত্ব ইত্যাদি। একজন সফল মুমিন আল্লাহর ও বান্দার এই সমস্ত আমানত যথাযথভাবে পালন করে।
মানুষের পারস্পরিক জীবনে প্রতিশ্রুতি রক্ষার ভূমিকা অনেক। এর মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা টিকে থাকে। কেউ যখন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তখন সে সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে, পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আর মুমিনের কাছে প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব আরও বেশি। আয়াতে ‘প্রতিশ্রুতি’ শব্দটিও ব্যাপক। আল্লাহ ও বান্দা উভয়ের সাথে মুমিনের যত প্রতিশ্রুতি এর সবগুলোই এতে শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন : তোমরা আমার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কর তাহলে আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করব। [সূরা বাকারা : ৪০] একজন মুমিন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার মাধ্যমেই আল্লাহর সাথে এই প্রতিশ্রতিতে আবদ্ধ হয় যে, সে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না, আল্লাহর সমস্ত বিধানের ক্ষেত্রে তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে। বেচা-কেনা থেকে শুরু করে বিয়ে-শাদি অর্থাৎ সমাজে চলতে একজন মুমিন অপরের সাথে যত জায়েজ প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে তাঁর সবই এই শব্দের ব্যপকতার অন্তর্ভুক্ত। একজন সফল মুমিন যাবতীয় সকল প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান ও তৎপর।
৬. নামাযের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করা
সফল মুমিনের ষষ্ঠ গুণ উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ
অর্থ : এবং যারা নিজেদের নামাযের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে। [সূরা মুমিনূন : ৯]
‘নামাযের রক্ষণাবেক্ষণ’ কথাটির মর্মও অতি ব্যাপক। যথাসময়ে নামায পড়া, নামাযের শর্ত, আদব ও অন্যান্য নিয়মাবলি রক্ষায় যত্নবান থাকা ও সুচারুরুপে নামায আদায় করা ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। একজন সফল মুমিন নামাযের যাবতীয় সকল ব্যাপারে যত্নবান হয়।
লক্ষ করুন, আল্লাহ তাআলা সফল মুমিনের গুণাবলির আলোচনা শুরু করেছেন নামাযের মাধ্যমে এবং শেষও করেছেন নামাযের মাধ্যমে। এ থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি―শরিয়তের দৃষ্টিতে নামাযের মর্যাদা কত বেশি। ঈমানের পরে নামায সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায়ের মুহুর্তে মুমূর্ষ অবস্থায়ও উম্মতকে তিনি বিশেষভাবে নামাযের অসিয়ত করে গেছেন। নামায যদি শুদ্ধ ও পরিশীলিত হয় তাহলে সেই নামাযই বান্দাকে অন্যান্য গুনাহ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
اِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهٰی عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِ
অর্থ : নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। [সূরা আনকাবূত : ৪৫]
সুতরাং যার নামায হবে যথার্থ, আল্লাহর মর্জিমাফিক, তার জন্য সফল মুমিনের অন্যান্য গুণাবলি অর্জন করা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
সফল মুমিনের পুরস্কার
পরবর্তী দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা উল্লিখিত গুণাবলির অধিকারী সফল মুমিনের পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْوٰرِثُوْنَ الَّذِیْنَ یَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ ؕ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ
অর্থ : এরাই হল উত্তরাধিকারী। যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকার লাভ করবে, তারা তাতে অনন্তকাল থাকবে। [সূরা মুমিনূন : ১০, ১১]
জান্নাতকে মুমিনদের মীরাস বা উত্তরাধিকার বলা হয়েছে। কারণ, মালিকানা লাভের যতগুলো সূত্র আছে তার মধ্যে মীরাস সূত্রটি অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট সম্পদ এ মীরাসের সূত্রে আপনা-আপনিই ব্যক্তির মালিকানায় আসে। জান্নাত মুমিনের পরকালীন উত্তরাধিকার। জান্নাত লাভের পর মুমিন ব্যক্তির এমন কোনো ভয় থাকবে না যে, সেই জান্নাত তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে কিংবা তাকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হবে। বরং নিশ্চিন্তমনে অনন্তকাল জান্নাতে বসবাস করবে।
সফল মুমিনগণ যে জান্নাত লাভ করবেন তা হচ্ছে, জান্নাতুল ফিরদাউস―সর্বোচ্চ জান্নাত। কারণ তারা দুনিয়াতে সর্বোচ্চ গুণাবলির অধিকারী হতে পেরেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলেন : ‘যখন তোমরা আল্লাহর কাছে জান্নাত চাইবে তখন তোমরা জান্নাতুল ফিরদাউস চাও। কেননা তা হচ্ছে সর্বোচ্চ জান্নাত। সেখান থেকেই জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হয়। আর তার উপরে রয়েছে রহমানের আরশ।’ [তিরমিযী, হাদীস ২৫৩০]
আল্লাহ তাআলার দরবারে একজন সফল মুমিন হিসেবে স্বীকৃত হতে হলে উল্লিখিত বিষয়গুলোকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিকারী হতে হলে উল্লিখিত গুণগুলোকে সর্বোত্তমভাবে নিজের মাঝে ধারণ করতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখাটি প্রস্তুত করেছেন : মাওলানা সাকিব মাহমুদ, শিক্ষক, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা; অতিথি লেখক, মুসলিমসডে.কম
Leave a Reply