
Post Updated at 19 May, 2025 – 1:03 PM
সৃষ্টিগতভাবেই যেহেতু নারী-পুরুষের মাঝে কিছু ভিন্নতা রয়েছে, তাই যে ইবাদতগুলো শারীরিক, সেসবের হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে কিছুটা ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক। হজ একই সঙ্গে শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত। হজ ফরজ হওয়ার বিষয় থেকে শুরু করে হজের আদায়পদ্ধতি সবক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের মাঝে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। আমরা এখানে এমন কয়েকটি ভিন্নতা তুলে ধরছি।
১. মাহরামের সাথে সফর
যে কোনো সফরেই একজন নারীর সঙ্গে তার স্বামী বা অন্য কোনো পুরুষ মাহরাম থাকা আবশ্যক। মাহরাম ব্যতীত নারীদের সফরকে শরিয়ত অনুমোদন করে না। মাহরাম হচ্ছে সেসব নিকটাত্মীয় পুরুষ, যাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ এবং যাদের সামনে পর্দা করতে হয় না। মেয়েদের মাহরাম যেমন, বাবা ভাই ছেলে চাচা মামা ভাতিজা ভাগিনা দুধভাই শ্বশুর প্রমুখ।
একজন নারী যখন উমরা বা হজের সফরে বের হবে, তখন তাকে অবশ্যই স্বামী বা এমন কোনো মাহরাম পুরুষের সঙ্গেই যেতে হবে। যদি একসঙ্গে একাধিক নারী সফর করার উদ্দেশ্যে বের হয় তাহলেও তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই মাহরাম থাকা আবশ্যক। পথের নিরাপত্তা যতই থাকুক না কেন, এ বিধানে কোনো হেরফের হবে না। হ্যাঁ, একাধিক নারী যদি এমন কোনো পুরুষের সাথে সফর করে, যিনি তাদের সকলেরই মাহরাম, তাহলে তা জায়েয হবে। যেমন, কেউ তার মা ও মেয়েকে কিংবা স্ত্রী ও মাকে নিয়ে সফর করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন একজন করে মাহরাম আবশ্যক নয়।
২. মাহরামের পথখরচের ব্যবস্থা
হজের সফরের জন্যে একজন নারীকে তো অবশ্যই তার এমন কোনো মাহরাম পুরুষের সন্ধান করতে হবে, যে সফরে তার সঙ্গে থাকবে। যদি সে মাহরাম পুরুষ নিজে থেকেই হজের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে, তাহলে সে নারীকে কেবল তার নিজের খরচ বহন করাটাই যথেষ্ট। কিন্তু যদি নিজে থেকে হজ করতে প্রস্তুত এমন কোনো মাহরাম পুরুষ না পাওয়া যায়, কিংবা কাউকে পাওয়া গেল, তবে সে মাহরাম তাকে সাথে রাখতে ইচ্ছুক নয়, তাহলে সে নারী অন্য কোনো মাহরাম পুরুষকে সাথে নিয়ে যাবে এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজনে নারী তার মাহরামের খরচও বহন করবে।
৩. ইহরাম
ইহরামের মধ্য দিয়েই হজের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। হজের ইহরাম নামাজের তাকবিরে তাহরিমার মতোই। মূলত ইহরাম হচ্ছে চূড়ান্তভাবে হজের নিয়ত করা এবং এ কথা বলা—হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্যে হজের নিয়ত করেছি, তুমি আমার এ হজ কবুল করে নাও এবং তা আদায় করা আমার জন্যে সহজ করে দাও। এ ইহরামের পর থেকে হজ আদায়কারীর কিছু স্বাভাবিক বিষয় নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন, সেলাই করা কাপড় পরা যাবে না, সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না, নখ-চুল কাটা যাবে না ইত্যাদি। তবে কাপড় পরিধান সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষের জন্যে ইহরাম অবস্থায় সেলাইকরা কাপড় পরা, মাথা ঢাকা এবং এমন জুতা পরা, যা পায়ের উপরের অংশ ঢেকে দেয়—এসব নিষিদ্ধ। আর নারীদের জন্যে এসবের কোনোটিই নিষিদ্ধ নয়। তারা তাদের স্বাভাবিক কাপড় ব্যবহার করবে। তাদের জন্যে নিষেধাজ্ঞা কেবল এতটুকু—তারা তাদের চেহারায় কোনো কাপড় লাগাতে পারবে না। চেহারা ব্যতীত অন্য কোনো অঙ্গ যেমন হাত-পা-ও তাদের খোলা রাখতে হবে না। বরং চাইলে তারা হাত-পায়ে মোজাও পরতে পারে। তবে হাতমোজা পরিধানের বিষয়ে দুই ধরনের দলিল থাকায় কেউ কেউ হাতমোজা না পরাকে উত্তম বলেছেন।
বিশেষ অপিবত্রতার সময়ও নারীরা ইহরাম বাঁধতে পারবে। তবে তারা এ অবস্থায় তাওয়াফ, কুরআন তেলাওয়াত ও নামাজ পড়তে পারবে না।
৪. পর্দার প্রতি যত্নবান হওয়া
অনেকে মনে করে, পুরুষ যেমন ইহরাম অবস্থায় তার মাথা উন্মুক্ত রাখবে, তেমনি নারীও ইহরাম অবস্থায় তার চেহারা খোলা রাখবে। ফলে পুরো সফরেই কোনো কোনো নারী চেহারা খোলা রেখে চলাফেরা করে। এ ধারণাটি সঠিক নয়। বরং একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপর সর্বাবস্থায় পর্দা রক্ষা করা ফরজ। অন্যান্য সময় যেমন পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা জরুরি, তেমনি ইহরাম-অবস্থায়ও তা আবশ্যক। বর্তমানে একধরনের ক্যাপ পাওয়া যায়, যার উপর দিয়ে নেকাব ব্যবহার করলে পর্দাও করা হয় এবং চেহারায় কাপড় না লাগানোর ওপরও আমল হয়ে যায়।
ক্যাপের উপর দিয়ে নেকাব পরলে বাতাসে কিংবা চলাফেরার সময় নেকাবের কাপড় চেহারায় লাগতে পারে। এতে অনেকে বিব্রত হন—হয়তো এতে ইহরামের ক্ষতি হয়ে গেল। কিন্তু মাসআলা হচ্ছে, এত অল্প সময় লাগলে কোনো অসুবিধা হয় না। তাই এ পন্থা অবলম্বন করে হলেও পর্দা করা জরুরি। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ১৪৫৩৯, ১৪৫৪০]
৫. তালবিয়া আস্তে বলা
ইহরামের পর থেকে তালবিয়া পাঠ অর্থাৎ ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক …’ পড়তে হয়। বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ শুরু করা পর্যন্ত এ তালবিয়া পাঠ করতে হয়। পুরুষেরা আওয়াজ করেই এ তালবিয়া পড়বে। তবে নারীরা এক্ষেত্রে তাদের স্বর উঁচু করবে না। বরং মনে মনে লাব্বাইক বলবে।
৬. রমল না করা
যে তাওয়াফের পর সাঈ করতে হয়, সে তাওয়াফে পুরুষেরা রমল করবে। অর্থাৎ প্রথম তিন চক্করে শরীর একটু দুলিয়ে দুলিয়ে দ্রুত চলবে। আর নারীরা এ রমল করবে না। তারা পুরো সাত চক্করই স্বাভাবিকভাবে আদায় করবে।
৭. ইহরামের সমাপ্তি
ইহরামের সমাপ্তিতে পুরুষকে তার মাথা মুণ্ডাতে হয় কিংবা চুল কেটে ছোট করতে হয়। মাথা মুণ্ডালে পূর্ণ মাথাই মুণ্ডন করতে হয়। আর চুল ছোট করলে মাথার চারভাগের একভাগের চুল কাটলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। তবে কেউ যদি মাথা না মুণ্ডিয়ে চুল ছোট করতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই আপাতত এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল কেটে ফেলতে হবে। যদি কারো চুল আগে থেকেই এক ইঞ্চির চেয়ে ছোট হয়ে থাকে, তাহলে তাকে মাথা মুণ্ডাতেই হবে, চুল ছোট করে কেটে নিলে যথেষ্ট হবে না। নারীরা এক্ষেত্রে মাথার চুল মুণ্ডাবে না, বরং তারাও এক কড়া বা এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল কেটে নেবে। পূর্ণ মাথার সবগুলো চুল কাটাও আবশ্যক নয়। বরং মাথার এক চতুর্থাংশের চুল এক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে নিলেই হয়ে যাবে।
৮. তাওয়াফের সময় পর্দা
মাথার চুল কাটার মধ্য দিয়েই ইহরাম সমাপ্ত হয় এবং ইহরামকারী হালাল হয়ে যায়। তখন নারী-পুরুষ সকলেই স্বাভাবিক কাপড়, সুগন্ধি ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবে। হালাল অবস্থায় তাওয়াফ করলেও স্বাভাবিক পোশাক পরেই তাওয়াফ করবে। নারীরা পূর্ণ পর্দা বজায় রাখবে। এবং এসময় তাদের আর মাথায় ক্যাপ ব্যবহার করতে হবে না। অনেক নারীকে দেখা যায়, তারা সবসময়ই চেহারা খোলা রেখে তাওয়াফ করে থাকে। এটা পর্দার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইহরাম অবস্থায়ও যেখানে চেহারা খোলা রাখার সুযোগ নেই, সেখানে হালাল অবস্থায় পর্দা না করার সুযোগ কোথায়! তাওয়াফ চলা কালে, হারামে যাওয়া-আসার সময় সহ সর্বদাই পর্দার বিধান মেনে চলতে হবে।
৯. ভিড় এড়িয়ে চলা
হজের সময় স্বাভাবিকভাবেই ভিড় হয়। একটু চেষ্টা করলে সে ভিড় এড়ানোও যায়। আবার নারী-পুরুষ সকলে একসাথেই তাওয়াফ করে। তাই নারীদের উচিত, তাওয়াফের সময় অন্য নারীদের সাথে সাথে চলা এবং বেপরোয়াভাবে পুরুষের ভিড়ে ঢুকে না পড়া। একটু সতর্কতার সাথে চললে সেখানে ভিড়ের মধ্যে পুরুষের সাথে ধাক্কাধাক্কি থেকে বেঁচে থাকা যায়। দিন দিন সেখানকার ভিড় যেমন বাড়ছে, তেমনি তাওয়াফের স্থানও সম্প্রসারিত হচ্ছে। মসজিদে হারামের দোতলা ও ছাদের উপর দিয়েও তাওয়াফ করার ব্যবস্থা রয়েছে। আবার মাতাফের নিচতলায় পুরুষেরা সবসময় যেতে পারে না। তাই একটু আন্তরিক হলেই তাওয়াফের সময় নারীরা পুরুষের ভিড় এড়িয়ে চলতে পারেন।
১০. নামাজের জন্যে প্রস্তুতি
মসজিদে হারামে নারীদের জন্যে আলাদা জায়গা রয়েছে। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ এ চেষ্টা করে থাকেন, যেন নামাজের সময় নারীরা পুরুষের মাঝে না থাকে এবং তারা যেন তাদের নির্ধারিত স্থানে নামাজ আদায় করে। হজের মূল সময় অত্যধিক ভিড়ের কারণে অবশ্য এ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। তবে নারীদের উচিত, তাওয়াফ বা অন্য কোনো ইবাদতে থাকাকালীন যদি পরবর্তী নামাজের সময় ঘনিয়ে আসে, তাহলে আগে থেকেই নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে নারীদের নির্ধারিত নামাজের স্থানে বসে পড়া।
১১. জামাতের সাথে নামাজ
হাদীসের ভাষ্য থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, নিজ ঘরই হচ্ছে নারীর নামাজ আদায়ের শ্রেষ্ঠ স্থান। তাই শুধু জামাতের সাথে নামাজ আদায় করার জন্যে মসজিদে হারামে (এবং মসজিদে নববীতেও) না যাওয়াই সমীচীন। হ্যাঁ, যদি তাওয়াফের উদ্দেশ্যে কিংবা অন্য কোনো কারণে মসজিদে হারামে থাকাবস্থায় নামাজের সময় হয়ে যায়, তাহলে সেখানে নারীদের নির্ধারিত স্থানে নামাজ আদায় করতে কোনো অসুবিধা নেই।
১২. অপবিত্রতার সময় তাওয়াফ
তাওয়াফের বিধান নামাজের মতোই। ছোট-বড় কোনো অপবিত্রতা নিয়েই তাওয়াফ করা যাবে না। কোনো নারী যদি সফরের শুরুতেই অপবিত্র থাকে, তাহলে পবিত্র হওয়ার পর সে তাওয়াফ করবে, এর পূর্বে সে তাওয়াফ করতে পারবে না। হজের মূল সময় ‘তাওয়াফুয যিয়ারাত’ নামে একটি তাওয়াফ করতে হয়। এ তাওয়াফটি করা ফরজ। যদি কেউ এ তাওয়াফ না করে দেশে ফিরে আসে, তাহলে আবার গিয়ে এ তাওয়াফ করা পর্যন্ত সে তার স্বামাী/স্ত্রীর জন্যে হালাল হতে পারবে না। এ তাওয়াফের সময় নির্ধারিত—১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত। যদি কেউ নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এ তাওয়াফটি আদায় করে, তাহলে তাকে দম দিতে হবে। কিন্তু যদি কোনো নারী এ সময়ে অপবিত্র হয়ে পড়ে, তাহলে সে পবিত্র হওয়ার পরই এ ফরজ তাওয়াফ করবে। অপবিত্র অবস্থায় করবে না। এবং এ বিলম্বের জন্যে তাকে দমও দিতে হবে না। আর যদি এ অপবিত্র অবস্থাতেই দেশে ফেরার ফ্লাইটের সময় হয়ে যায় এবং তা পিছিয়ে নেয়া সম্ভব না হয়, তাহলে এ অবস্থাতেই তাওয়াফ করে নেবে এবং অপবিত্র অবস্থায় তাওয়াফের জন্যে একটি উট বা গরু দম হিসেবে কুরবানি করতে হবে। তবে ফরজ তাওয়াফ করার পর যদি কোনো নারী অপবিত্র হয় এবং এমতাবস্থায়ই দেশে ফেরার সময় হয়ে যায়, তাহলে সে বিদায়ী তাওয়াফ না করেই ফিরে আসবে। এ তাওয়াফটি ওয়াজিব। কিন্তু এ ওয়াজিব আমলটি না করার জন্যে সে নারীকে দম দিতে হবে না।
Leave a Reply