Press ESC to close

থার্টি ফার্স্ট নাইট : আয়োজন, না আগ্রাসন?

Post Updated at 20 Dec, 2024 – 10:07 AM

ইংরেজি নববর্ষের প্রথম প্রহরের আয়োজন—থার্টি ফার্স্ট নাইট। এ ক্যালেন্ডার এবং এর নববর্ষের ক্ষণটি উদযাপনের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে খ্রিষ্ট ধর্ম। আবার নববর্ষ উদযাপনের জন্যে উৎসব-আয়োজনও ইসলামি শরিয়তে স্বীকৃত নয়। তাই আল্লাহবিশ্বাসী একজন মুসলিম হিসেবে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজনে অংশগ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু থার্টি ফার্স্ট নাইট আয়োজনের নামে আমাদের এ দেশে, বিশেষত রাজধানী ঢাকায়, যা কিছু হয়ে থাকে, তা কি আসলেই কোনো উৎসব-আয়োজন, না একটি আগ্রাসন—আজকের অবসরে আমরা এ বিষয়েই আলোকপাত করতে চাই।

 

থার্টি ফার্স্ট নাইটের প্রধান ‘আকর্ষণ’—আতশবাজি, পটকা ও ফানুস। শীতকালের রাতদুপুরে যখন আতশবাজির একের পর এক বিকট শব্দে প্রকম্পিত হতে থাকে চারপাশ, কত মানুষের তখন ঘুম ভেঙে যায় আর কত শত রোগী ও বৃদ্ধ মানুষ কষ্ট পোহায়—তা কি আমরা ভেবে দেখেছি! আনন্দ-ফূর্তির নামে এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়া তো কোনো সভ্যতা হতে পারে না। হতে পারে না একটি সভ্য জাতির আয়োজন। আর বলাবাহুল্য, একজন মুসলমানের জন্যে এমন আগ্রাসী আয়োজনে শরিক হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده

মুসলিম তো সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলমানেরা নিরাপদ থাকে। [সহীহ বুখারী, হাদীস : ১০]

ক্ষতি শুধু সাধারণ মানুষের কিংবা রোগী ও বৃদ্ধদের ঘুম ভেঙে দেয়াই নয়, ঘটে নানা দুর্ঘটনাও। পত্রপত্রিকায় সেগুলো ছাপাও হয়। গত কয়েক বছর ধরে পুলিশের পক্ষ থেকেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এসব আয়োজনের ওপর। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ধর্মীয় নির্দেশনা, মানবতার আহ্বান, প্রশাসনিক কড়াকড়ি—কোনোকিছুই থামাতে পারে না এ আয়োজন। সকল বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে এ আয়োজনে আমাদের এই যে ‘দৃঢ়তা ও অবিচলতা’, এতে যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, দেশের ও দেশের মানুষের, তা কি ভেবে দেখেছি কখনো?

বিডিনিউজ২৪.কম-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট লক্ষ করুন—‘(শিরোনাম 🙂 বর্ষবরণের ফানুস বিদ্যুতের তারে, মেট্রোরেল দুই ঘণ্টা বন্ধ।’ ভেতরে লেখা হয়েছে— ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে গিয়ে মধ্যরাতে ওড়ানো ফানুস বৈদ্যুতিক তারের ওপর পড়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে বছরের প্রথম দিন মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে দুই ঘণ্টা দেরিতে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) এমডি এম এন ছিদ্দিক রোববার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ কথা জানান। তিনি বলেন,

গতরাতে ওড়ানো অনেক ফানুস মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক তারে এসে পড়েছে। ডিএমপি থেকে বারবার ফানুস ওড়াতে নিষেধ করার পরও কেউ তা শোনেনি। দুর্ঘটনা রোধে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রাখতে হল। সকাল থেকে তারের ওপর থেকে ফানুস অপসারণের কাজ চলে। ১০টার পর ট্রেন চলাচাল শুরু করা গেছে।

খ্রিস্টীয় বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে গত কয়েকবছর ধরেই বাজি-পটকা এবং ফানুসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তবে প্রতিবছরের মত এবারও নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে নতুন বছরের প্রথম প্রহরে ঢাকা কেঁপে উঠেছে বাজি-পটকার শব্দে। আকাশে ভেসেছে অসংখ্য ফানুস। সেই জ্বলন্ত ফানুস নিচে পড়ে অগ্নিকাণ্ডেরও খবর দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। কয়েকটি জায়গায় ফানুস পড়ে বিদ্যুতের তারও পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার এরশাদ হোসেন শনিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদের কাছে নবাবপুর রোডের কাপ্তানবাজার, লালবাগ ও সদরঘাট হকার্স মার্কেটে ফানুস পড়ে আগুনের খবর এসেছে। এর মধ্যে সদরঘাট হকার্স মার্কেটে ফানুস থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে বিদ্যুতের তার পুড়ে যায়। লালবাগেও অগ্নিকাণ্ড ঘটে বিদ্যুতের তারে ফানুস পড়ে। এছাড়া আদাবরেও বিদ্যুতের তারে ফানুস পড়ার খবর পাওয়া যায়। তার পুড়ে যাওয়ায় লালবাগ ও আদাবরের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’

বিডিনিউজ এ রিপোর্টটি প্রকাশ করে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি, সকাল নয়টা আটত্রিশ মিনিটে। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়, থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজন-মুহূর্তের সামান্য পূর্বে তারা আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এবারের শিরোনাম : বর্ষবরণের আতশবাজি-ফানুসে কত ক্ষতি, জানাল ফায়ার সার্ভিস। ভেতরের তথ্য—‘২০২২ সালের থার্টি ফাস্ট নাইটে আতশবাজি ও ফানুস থেকে যে প্রায় একশ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ফায়ার সার্ভিস রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, সেসব অগ্নিকাণ্ডে আনুমানিক ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি গুনতে হয়েছিল নতুন বছরের শুরুতে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ২০২১ সালের প্রথম প্রহরে আতশবাজি ও ফানুস থেকে ১৬টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছিল। আতশবাজির উচ্চ শব্দে তানজিম উমায়ের মাহমুদুল হাসান নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ২০২০ সালে একই রকম ৫০টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৭২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা এবং ২০১৮ সালে ৪২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৫৬ লাখ ৬ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।’

একটু আনন্দ-বিনোদন আর স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে কেউ হয়তো এ আয়োজনের প্রতি নমনীয় হতে পারেন। কিন্তু কথা হলো, যে আনন্দ উৎসবে শিশুর মৃত্যু হয়, যে আয়োজনে শত শত অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটে, যে আয়োজন শত-সহস্র মানুষের জীবনের স্বাভাবিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে, যে আয়োজন দেশের জন্যে ক্ষতিকর, সেটা কোনো আয়োজন হতে পারে না। সেটা স্পষ্টই এক সীমালঙ্ঘন, আগ্রাসন—এটা নিয়ে কোনোরূপ বিতর্কের অবকাশ নেই।

ইসলাম কী বলে?

ইতিপূর্বে আমরা বলে এসেছি, এ ধরনের উৎসব আয়োজন করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। অর্থহীন এসব আয়োজনকে কোথাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কোথাও করা হয়েছে নিরুৎসাহিত। আল্লাহ তাআলার বাণী—

ومن الناس من يشتري لهو الحديث ليضل عن سبيل الله بغير علم ويتخذها هزوا أولئك لهم عذاب مهين

মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত আল্লাহ পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্যে অসার বাক্য ক্রয় করে নেয় এবং আল্লাহ-প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা করে। তাদেরই জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি। [সূরা লুকমান, আয়াত : ৬]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

من حسن إسلام المرأ تركه ما لا يعنيه

ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য—অর্থহীন বিষয় মানুষ ছেড়ে দেবে। [জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩১৭]

আর থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজন কেবলই যে অর্থহীনতার দোষে দুষ্ট, বিষয়টা এমনও নয়। এ আয়োজনের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। এর পাশাপাশি রয়েছে একটি অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থব্যয়ের অপরাধ। আমার টাকা আমি যেখানে ইচ্ছা খরচ করব—এমন স্বাধীনতা ইসলামে স্বীকৃত নয়। টাকা উপার্জনের ক্ষেত্রে যেমন শরিয়তের পক্ষ থেকে রয়েছে নানা নির্দেশনা ও সীমাবদ্ধতা, ব্যয়ের ক্ষেত্রটিও অনুরূপ। আয়-ব্যয় দুটোই করতে হবে শরিয়তের বিধান মেনে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ؛ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَ أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ، وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ، وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ.

কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে বনি আদমের পা দুটি নড়বে না, যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। (এক.) তার জীবন সম্পর্কে—কোথায় তা ব্যয় করেছে, (দুই.) তার যৌবন সম্পর্কে—কোথায় তা শেষ করেছে, (তিন ও চার.) তার সম্পদ সম্পর্কে—কোত্থেকে তা উপার্জন করেছে এবং কোথায় তা খরচ করেছে, (পাঁচ.) সে যা শিখেছে সে অনুযায়ী কী আমল করেছে? [জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪১৬]

আল্লাহ তাআলার দরবারে সম্পদ সম্পর্কিত এ জবাবদিহিতার মুখোমুখি হওয়ার আগেই আমাদের সতর্ক হতে হবে আয় ও ব্যয়ের খাত সম্পর্কে। আর সন্দেহ নেই, থার্টি ফার্স্ট নাইটের মতো আগ্রাসী আয়োজনে আমাদের অংশগ্রহণ কিয়ামতের দিন সে জবাবদিহিতাকে কঠিন করে তুলবেই। পরকালে মুক্তি পেতে হলে, সর্বোপরি মানবতার কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাইলে এসব আগ্রাসন থেকে নিজেকে এবং নিজের অধীনস্থদেরকে বিরত রাখতেই হবে।
আসুন, দাওয়াতটি ছড়িয়ে দিই।

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

উসতাযুল হাদীস, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া ঢাকা, মোহাম্মদপুর। মাসিক আলকাউসারসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। তাঁর লিখিত বইও পাঠক মহলে নন্দিত হয়েছে। তিনি মুসলিমস ডে অ্যাপের শরয়ী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

Comments (2)

  • Md Saiful Islam Sagorsays:

    December 21, 2024 at 12:36 PM

    আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন আমিন 🤲

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাইট হিট কাউন্টার

সর্বমোট পোস্ট ভিউ: ২,০৩৯,৮০১

পোস্ট কপি করার অপশন বন্ধ রাখা হয়েছে। অনুগ্রহ করে পোস্টের লিংক কপি করুন