Press ESC to close

তিলাওয়াতে সিজদা: ফাজায়েল ও মাসায়েল

Post Updated at 19 Sep, 2024 – 8:08 PM

তিলাওয়াতে সিজদা কী?

কোরআনে সর্বমোট ১৪ টি আয়াত এমন আছে, যেগুলো শুনলে বা তিলাওয়াত করলে একটি  সিজদা করতে হয়। এই সিজদাকে তিলাওয়াতে সিজদা বলা হয়।

তিলাওয়াতে সিজদা আদায়ের পদ্ধতি

তিলাওয়াতে সিজদা আদায়ের উত্তম পদ্ধতি হলো, দাঁড়িয়ে হাত উঠানো ছাড়া আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যাবে। অত:পর সিজদায় তিনবার سبحان ربي الأعلى পড়ে পুনরায় আল্লাহু আকবার বলে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে যাবে।এভাবে শুধু একটি সিজদা করবে। একসাথে একাধিক তিলাওয়াতে সিজদা আদায় করতে চাইলেও একই নিয়মে করবে। 

সিজদা একটি হোক বা একাধিক হোক সিজদার জন্য দাঁড়ানো জরুরী নয়। বসে বসেও তিলাওয়াতে সিজদা আদায় করা যায়। তবে দাঁড়িয়ে সিজদায় যাওয়া উত্তম। [আদ্দুররুল মুখতার- ২/১০৭]

তিলাওয়াতে সিজদার হুকুম

তিলাওয়াতে সিজদার কোনো আয়াত পাঠ বা শ্রবণ করলে একটি সিজদা করা ওয়াজিব। সিজদা না করলে গুনাহগার হবে। [মারাকিল ফালাহ – পৃ:৪৮৯]

তিলাওয়াতে সিজদার হেকমত

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোরআনের অন্য আয়াতগুলো তিলাওয়াত করলে  সিজদা করতে হয় না। তাহলে এ নির্দিষ্ট আয়াতগুলো তিলাওয়াত করলে কেন সিজদা করতে হয়? এর হেকমত কী?

তাফসীরে রুহুল মাআ’নীতে এর তিনটি হেকমত বর্ণিত হয়েছে।

১) কোরআনের কিছু আয়াত এমন আছে যার মধ্যে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে সুস্পষ্টভাবে সেজদা করতে আদেশ করেছেন।  আল্লাহর নির্দেশ তৎক্ষনাৎ পালনার্থে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করার পর তিলাওয়াতে সিজদা আদায় করা হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা সূরা নাজমের শেষে বলেন,  فاسجدوا لله অর্থ- তোমরা আল্লাহকে সিজদা করো।

(সূরা- নাজম, আয়াত-৬২)

২) কোরআনের কিছু আয়াতে আল্লাহ তাআলা কাফেরদেরকে সিজদা করতে আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু কাফেররা আল্লাহর হুকুম অমান্য করায় মুমিনদেরকে কাফেরদের বিরোধিতা ও লাঞ্চনা প্রকাশার্থে সিজদা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন সূরাতুল ফোরকানে আল্লাহ বলেন,

اِذَا قِیْلَ لَهُمُ اسْجُدُوْا لِلرَّحْمٰنِ قَالُوْا وَ مَا الرَّحْمٰنُ ۗ-اَنَسْجُدُ لِمَا تَاْمُرُنَا وَ زَادَهُمْ نُفُوْرًا۠

অর্থ- যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা রহমানকে সিজদা করো; তখন তারা বলে, রহমান আবার কী? তুমি যে-কাউকে সিজদা করতে বললেই কি আমরা সিজদা করবো? এতে তারা আরো বেশি বিমুখ হয়ে পড়ে। [সূরা ফোরকান, আয়াত-৬০]

৩) কোরআনের কিছু আয়াতে আল্লাহ তাআলা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম,ফেরেশতা ও নৈকট্যশীল বান্দাদের আল্লাহকে সিজদা করার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাই সকল মুমিন-মুসলমানকে এই সমস্ত মহান ব্যক্তিদের অনুসরণে উক্ত আয়াত তিলাওয়াতের পর সিজদা করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। যেমন সূরা সোয়াদে আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَاسْتَغْفَرَ رَبَّهٗ وَ خَرَّ رَاكِعًا وَّ اَنَابَ

অর্থ- অতঃপর তিনি (দাউদ আঃ) তাঁর প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন আর আল্লাহর অভিমুখী হলেন। [সূরা- সোয়াদ, আয়াত-২৪]

(তাফসীরে রুহুল মাআ’নী- সূরা আ’রাফ,৫/১৪৪)

 তিলাওয়াতে সিজদার ফজিলত

তিলাওয়াতে সেজদায় বান্দা কোরআনের সুনির্দিষ্ট কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে বা শুনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে মহান প্রভুকে প্রেম নিবেদন করে কোরআনের ভাব ও ভাবনার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। তিলাওয়াতের মাঝে এমন সিজদা যেন কোরআনী পয়গামের সামনে নিজের সর্বসত্তা বিলিয়ে দেয়ার এক ঐশী স্পৃহা। হাদীসে  সিজদার অনেক ফজীলত বর্ণিত হয়েছে। 

সিজদার ফযীলত সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

إِذَا قَرَأَ ابْنُ آدَمَ السَّجْدَةَ فَسَجَدَ اعْتَزَلَ الشَّيْطَانُ يَبْكِي، يَقُولُ: يَا وَيْلَهُ وَفِي رِوَايَةِ أَبِي كُرَيْبٍ: يَا وَيْلِي أُمِرَ ابْنُ آدَمَ بِالسُّجُودِ فَسَجَدَ فَلَهُ الْجَنَّةُ، وَأُمِرْتُ بِالسُّجُودِ فَأَبَيْتُ فَلِيَ النَّارُ.

আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে সিজদায় যায়, তখন শয়তান কেঁদে কেঁদে দূরে সরে যায় এবং বলতে থাকে, দুর্ভাগ্য  আমার! আদম সন্তানকে সিজদার জন্য আদেশ করলে সে সিজদা করে জান্নাত লাভ করল। আর আমাকে সিজদার জন্য আদেশ করা হলেও আমি সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানালাম; ফলে আমি জাহান্নামী হলাম। [সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৩]

সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন—

كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ السَّجْدَةَ وَنَحْنُ عِنْدَهُ، فَيَسْجُدُ وَنَسْجُدُ مَعَهُ، فَنَزْدَحِمُ حَتّٰى مَا يَجِدُ أَحَدُنَا لِجَبْهَتِهِ مَوْضِعًا يَسْجُدُ عَلَيْهِ.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করতেন। অতঃপর সিজদা করতেন। আমরাও তাঁর সাথে সিজদা করতাম। এতো ভিড় হতো যে, আমাদের মাঝে কেউ কেউ সিজদা করার জন্য কপাল রাখার জায়গা পেত না। [সহীহ বুখারী, হাদীস ১০৭৬]

কোরআন মাজীদে মোট সিজদার আয়াত সংখ্যা

কোরআন মাজীদে সিজদার আয়াত সর্বমোট ১৪টি। হিন্দুস্তানি মুসহাফগুলোতে সে আয়াতগুলোর উপরে বা নিচে লম্বা দাগ টেনে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং আয়াতের শেষে ‘সিজদা’ লেখা আছে। অবশ্য ইমাম শাফেয়ী রহ. এর মতে এই আয়াতগুলো ছাড়াও সূরা হজ্বের ৭৭নং আয়াতও সিজদার আয়াত। কিন্তু হানাফী মাযহাব মতে এই আয়াতটি সিজদার আয়াত নয়।  তাই সূরা হজ্বের ৭৭নং আয়াতে সিজদা করা আবশ্যক নয়। তবে সিজদা করে নেয়া উত্তম। [ইলাউস সুনান ৭/২৪৪-২৪৫]

তিলাওয়াতে সিজদার মাসায়েল

তিলাওয়াতে সিজদা কার উপর ওয়াজিব

মাসআলা- মুসলমান, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন, প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি  তিলাওয়াতে সিজদার আয়াত পাঠ বা শ্রবণ করল সিজদা আদায় করা ওয়াজিব। তাই কাফের , পাগল বা নাবালেগ বাচ্চার উপর তিলাওয়াতে সিজদা আদায় করা ওয়াজিব নয়। [রদ্দুল মুহতার-২/১০৭]

মাসআলা- হায়েয ও নেফাসগ্রস্ত মহিলা কারো কাছ থেকে সিজদার আয়াত শুনলে সিজদা ওয়াজিব হয় না। [রদ্দুল মুহতার-২/১০৭]

আয়াতের কতটুকু অংশ পড়লে সিজদা ওয়াজিব হবে

মাসআলা- গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী সিজদার আয়াতের সিজদা সম্বলিত অংশসহ আগে বা পরের শব্দ মিলিয়ে পড়লে সিজদা ওয়াজিব হবে। আগে-পরে না মিলিয়ে শুধু সিজদার অংশ তিলাওয়াত করলে বা সিজদার অংশ বাদ দিয়ে পুরা আয়াত তিলাওয়াত করলে সিজদা ওয়াজিব হবে না।  [রদ্দুল মুহতার ২/১০৩]

একটি আয়াত একাধিকবার কিংবা একাধিক আয়াত একবার করে পড়লে

যদি একাধিক সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করা হয় (হোক সেটা একই মজলিসে বা ভিন্ন মজলিসে), তাহলে প্রতিটি আয়াত তিলাওয়াতের জন্য আলাদা সিজদা করতে হবে। [আদদুররুল মুখতার ২/১০৩; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলালমারাকী, পৃ. ৪৯৩]

যদি কোনো সিজদার আয়াত এক বৈঠকে একাধিকবার তিলাওয়াত বা শ্রবণ করা হয়, তাহলে শুধু একটি সিজদাই ওয়াজিব হয়। [আদদুররুল মুখতার ২/১০৩; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলালমারাকী, পৃ. ৪৯৩] অবশ্য একটি আয়াত একাধিক বৈঠকে পড়লে প্রতি বৈঠকের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন সিজদা ওয়াজিব হবে।

নামাজে তিলাওয়াতে সিজদা করতে ভুলে গেলে করণীয়

মাসআলা-  নামাযে সিজদার আয়াত তিলাওয়াতের পর ভুলবশত তিলাওয়াতে সিজদা না করলে এবং পরবর্তীতে নামাযের ভিতরেই সিজদার কথা স্মরণ হলে সঙ্গে সঙ্গে সিজদাটি আদায় করে নেবে। অতঃপর বাকি নামায যথারীতি আদায় করবে এবং বিলম্বে সিজদা করার কারণে নামায শেষে সিজদায়ে সাহু করে নেবে।

আর যদি নামাজের ভিতর সিজদার কথা একদমই মনে না থাকে এবং সালাম ফিরানোর পর নামাজের পরিপন্থী কাজ না করে; যেমন কথা বলা ইত্যাদি, এমতাবস্থায় তিলাওয়াতে সিজদা করে নেবে এবং সাহু সিজদা আদায় করবে। আর যদি নামাজের পরিপন্থী কোনো কাজ করে ফেলে তাহলে উক্ত সিজদার কোনো কাজা নেই। সিজদাটি করার আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ নামাজের ভেতর ওয়াজিব হওয়া সিজদা নামাজেই আদায় করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সিজদাটি করতে না পারায় আল্লাহর কাছে তাওবা ইসতিগফার করে নিবে। 

[রদ্দুল মুহতার ২/১১০]

মাকরুহ ওয়াক্তে তিলাওয়াতে সিজদা আদায়ের হুকুম

নামাজের মাকরুহ ওয়াক্তে তথা সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও ঠিক ‍দুপুরে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে উক্ত সময়ে সিজদা করলে আদায় হয়ে যাবে ঠিক , তবে তা অনুত্তম। কিন্তু অন্যসময়ের তিলাওয়াতে সিজদা মাকরুহ ওয়াক্তে আদায় করলে তা সহীহ হবে না। — রদ্দুল মুহতার ২/১০৬;  বাদায়েউস সানায়ে ১/১৮৭ 

যানবাহনে সিজদার আয়াত তিলাওয়াতের হুকুম

মাসআলা- যানবাহনে সফর করা অবস্থায় একটি সিজদার আয়াত বারবার তিলাওয়াত করলেও একটি সিজদা ওয়াজিব হবে। আদদুররুল মুখতার ২/১১৬; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলালমারাকী, পৃ. ৪৯৬;

রেকর্ড থেকে সিজদার আয়াত শুনলে

মাসআলা- বুঝমান, সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তি থেকে সিজদার আয়াত শ্রবণ করলে তিলাওয়াতে সিজদা ওয়াজিব হয়। পূর্বে ধারণকৃত অডিও-ভিডিও থেকে সিজদার আয়াত শ্রবণ করলে সিজদা ওয়াজিব হবে না। তবে এসব ক্ষেত্রেও সিজদা করে নেওয়া উত্তম। —রদ্দুল মুহতার ২/১০৮; বাদায়েউস সানায়ে ১/১৮৬

লাইভ (সরাসরি সম্প্রচার) থেকে সিজদার আয়াত শুনলে তিলাওয়াতে সিজদার হুকুম

মাসআলা-  সরাসরি সম্প্রচার (লাইভ) থেকে সিজদার আয়াত শুনলে তিলাওয়াতে সিজদা ওয়াজিব হবে। সুতরাং অনলাইনে তিলাওয়াত, বয়ান-বক্তৃতায় সিজদার আয়াত লাইভে সম্প্রচারিত হলে শ্রোতাদের উপর সিজদা করা ওয়াজিব হবে। এমনিভাবে মাইক বা লাউডস্পিকারে সরাসরি (রেকর্ড নয়) কারো সিজদার আয়াত তিলাওয়াত শুনলে শ্রোতাদের উপর তিলাওয়াতে সিজদা ওয়াজিব হবে। —জাওয়াহিরুল ফিকহ ৭/৪৫৬; কিতাবুল মাসাইল-১/৫৩৮;

সিজদার আয়াতের অনুবাদ পড়লে সিজদায়ে তিলাওয়াত

মাসআলা- সিজদার আয়াতের অনুবাদ পাঠ করলে পাঠক বা শ্রোতা কারও উপরই সিজদা ওয়াজিব হবে না। এটাই বিশুদ্ধ মত। তবে কোনো কোনো ফকীহ এ ক্ষেত্রে সিজদা ওয়াজিব হওয়ার কথা বলেছেন। তাই সতর্কতামূলক সিজদা করে নিলেই ভালো। —বাদাইয়ুস সানায়ে, ১/২৬৮ (দারুল ফিকর সংস্করণ) 

সিজদার আয়াত লিখলে বা টাইপ করলে সিজদায়ে তিলাওয়াত

মাসআলা- মুখে উচ্চারণ না করে সিজদার আয়াত শুধু লিখলে, টাইপ করলে বা মনে মনে পড়লে তিলাওয়াতে সিজদা ওয়াজিব হবে না।  —রদ্দুল মুহতার ২/১০৩,১০৯; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলালমারাকী, পৃ. ৪৭৯।

তিলাওয়াতে সিজদার জন্য আয়াত নির্দিষ্ট করা জরুরী নয়

সিজদার একাধিক আয়াত তিলাওয়াত করলে সিজদার জন্য আয়াত নির্দিষ্ট করে সিজদা দেয়া জরুরী নয়। বরং সিজদার সংখ্যা হিসাব করে নিয়ত ছাড়া সে পরিমাণ সিজদা করে নিলেই চলবে। —রদ্দুল মুহতার ২/১০৯; 

অনাদায়ী সিজদার সংখ্যা স্মরণ না থাকলে করণীয়

মাসআলা- যদি তিলাওয়াতে সিজদা অত্যধিক পরিমাণে অনাদায়ী থাকে এবং অনাদায়ী সিজদার সংখ্যাও নিশ্চিতভাবে জানা না থাকে; তাহলে প্রবল ধারণার ভিত্তিতে একটি সংখ্যা নির্ধারণ করে সে পরিমাণ সিজদা আদায় করে নেবে। —আদদুররুল মুখতার ২/১০৯;

কিছু ভুল আমল

সিজদার আয়াত বাদ দিয়ে তিলাওয়াত করা

মাসআলা- তিলাওয়াতের সময় সিজদার আয়াত আসলে তা বাদ দিয়ে তিলাওয়াত করা একটি ভুল পদ্ধতি। তিলাওয়াতের সময় সিজদার আয়াত বাদ দেওয়া কুরআনের আদব পরিপন্থী। আল্লাহর কালাম ধারাবাহিকভাবেই পড়ে যাওয়া উচিত। তৎক্ষণাৎ সিজদা করতে না পারলে পরবর্তীতে সিজদা করে নেবে। — আদ্দুররুল মুখতার ২/১১৭

সারা জীবনের জন্য চৌদ্দটি সিজদা

মাসআলা- অনেকে মনে করেন, সারা জীবন তিলাওয়াতের কারণে যত সিজদাই ওয়াজিব হোক, চৌদ্দটি সিজদা করে নিলে সবগুলো সিজদা আদায় হয়ে যাবে। এ ধারণাটি মারাত্মক ভুল। তিলাওয়াতকৃত প্রতিটি সিজদার জন্য পৃথক পৃথক সিজদা দিতে হবে। হ্যাঁ, যদি এক বৈঠকে একটি সিজদার আয়াত একাধিকবার পড়া হয় তাহলে কেবল একটি সিজদাই ওয়াজিব হয়। — বাদাইয়ুস সানায়ে, ১/২৬৮

সিজদার আয়াতসমূহ

إِنَّ الَّذِينَ عِنْدَ رَبِّكَ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيُسَبِّحُونَهُ وَلَهُ يَسْجُدُونَ ۞

অর্থঃ নিশ্চয়ই যারা (অর্থাৎ ফিরিশতাগণ) তোমার রবের সান্নিধ্যে আছে, তারা তাঁর ইবাদত থেকে অহংকারে মুখ ফেরায় না এবং তাঁর তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁরই সম্মুখে সিজদাবনত হয়। (সূরা- আ’রাফ, আয়াত-২০৬)

 وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَظِلَالُهُمْ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ۞

অর্থঃ আর আল্লাহকেই সিজদা করে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টি, কেউ তো স্বেচ্ছায় এবং কেউ বাধ্য হয়ে। তাদের ছায়াও সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর সামনে সিজদায় লুটায়।  —সূরা-আর রা’দ, আয়াত – ১৫

وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ ۞ يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ ۞

অর্থঃ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তারা এবং সমস্ত ফেরেশতা আল্লাহকেই সিজদা করে এবং তারা মোটেই অহংকার করেনা। তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, যিনি তাদের উপরে এবং তারা সেই কাজই করে, যার আদেশ তাদেরকে করা হয়। —সূরা-আন নাহ্‌ল, আয়াত ৪৯- ৫০

قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا۞ وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا ۞ وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا۞

অর্থঃ (কাফেরদেরকে) বলে দাও, তোমরা এতে ঈমান আন বা নাই আন, যাদেরকে এর আগে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল, তাদের সামনে যখন (কোরআন) পড়া হয়,তখন তারা থুতনি ফেলে সিজদায় পড়ে যায়।  এবং তারা বলে,আমাদের প্রতিপালক পবিত্র, নিশ্চই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা বাস্তবায়িত হয়েই থাকে। এবং তারা কাঁদতে কাঁদতে থুতনির উপর লুটিয়ে পড়ে এবং এটা (অর্থাৎ কুরআন) তাদের অন্তরের বিনয় আরও বৃদ্ধি করে।     —সূরা-বনী-ইসরাঈল, আয়াত – ১০৭-১০৯

 أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا۞

অর্থঃ আদমের বংশধরদের মধ্যে এরাই সেই সকল নবী, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। এদের কতিপয় সেই সব লোকের বংশধর, যাদেরকে আমি নূহের সাথে (নৌকায়) আরোহণ করিয়েছিলাম এবং কতিপয় ইবরাহীম ও ইসরাঈল (অর্থাৎ হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম)-এর বংশধর। আমি যাদেরকে হিদায়াত দিয়েছিলাম ও (আমার দীনের জন্য) মনোনীত করেছিলাম, এরা তাদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সামনে যখন দয়াময় আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হত, তখন তারা কাঁদতে কাঁদতে সিজদায় লুটিয়ে পড়ত।    —সূরা-মারইয়াম, আয়াত – ৫৮

  اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ یَسۡجُدُ لَہٗ مَنۡ فِی السَّمٰوٰتِ وَمَنۡ فِی الۡاَرۡضِ وَالشَّمۡسُ وَالۡقَمَرُ وَالنُّجُوۡمُ وَالۡجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَآبُّ وَکَثِیۡرٌ مِّنَ النَّاسِ ؕ  وَکَثِیۡرٌ حَقَّ عَلَیۡہِ الۡعَذَابُ ؕ  وَمَنۡ یُّہِنِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ مُّکۡرِمٍ ؕ  اِنَّ اللّٰہَ یَفۡعَلُ مَا یَشَآءُ ؕٛ۞

অর্থঃ তুমি কি দেখনি আল্লাহর সম্মুখে সিজদা করে যা-কিছু আছে আকাশমণ্ডলীতে, যা-কিছু আছে পৃথিবীতে এবং সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পাহাড়, বৃক্ষ, জীবজন্তু ও বহু মানুষ? আবার এমনও অনেক আছে, যাদের প্রতি শাস্তি অবধারিত হয়ে আছে। আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন তার কোনো সম্মানদাতা নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ করেন যা তিনি চান।     —সূরা-আল হাজ্জ্ব, আয়াত – ১৮

وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اسْجُدُوا لِلرَّحْمَنِ قَالُوا وَمَا الرَّحْمَنُ أَنَسْجُدُ لِمَا تَأْمُرُنَا وَزَادَهُمْ نُفُورًا۞

অর্থঃ তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘রহমান’কে সিজদা কর, তারা বলে রহমান কী? তুমি যে-কাউকে সিজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সিজদা করব? এতে তারা আরও বেশি বিমুখ হয়ে পড়ে। —সূরা- আল ফুরকান, আয়াত – ৬০

 أَلَّا يَسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي يُخْرِجُ الْخَبْءَ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَيَعْلَمُ مَا تُخْفُونَ وَمَا تُعْلِنُونَ۞ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ ۞

অর্থঃ (ফলে তারা হেদায়েত থেকে এত দূরে) যে, আল্লাহকে সিজদা করেনা। যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর গুপ্ত বিষয়াবলী প্রকাশ করেন এবং তোমরা যা গোপন কর ও প্রকাশ কর তিনি সবই জানেন। আল্লাহ তিনি, যিনি ছাড়া কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়, তিনি মহা আরশের অধিপতি। —আন নাম্‌ল – ২৫-২৬

 إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِهَا خَرُّوا سُجَّدًا وَسَبَّحُوا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ۞

অর্থঃ আমার আয়াতসমূহে তো ঈমান আনে কেবল তারা, যারা এর দ্বারা যখন উপদেশ প্রাপ্ত হয়, তখন সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং নিজ প্রতিপালকের সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে। আর তারা অহংকার করে না।   —সূরা-আস সিজদাহ্‌, আয়াত – ১৫

 قَالَ لَقَدْ ظَلَمَكَ بِسُؤَالِ نَعْجَتِكَ إِلَى نِعَاجِهِ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ الْخُلَطَاءِ لَيَبْغِي بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَقَلِيلٌ مَا هُمْ وَظَنَّ دَاوُودُ أَنَّمَا فَتَنَّاهُ فَاسْتَغْفَرَ رَبَّهُ وَخَرَّ رَاكِعًا وَأَنَابَ۞

অর্থঃ দাঊদ বলল, সে তার দুম্বাদের সাথে মেলানোর জন্য তোমার দুম্বাটিকে দাবি করে নিশ্চয়ই তোমার উপর জুলুম করেছে। যাদের মধ্যে অংশীদারিত্ব থাকে, তাদের অনেকেই একে অন্যের প্রতি জুলুম করে থাকে। ব্যতিক্রম কেবল তারা, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে। কিন্তু  তারা  বড়  কম। তখন  দাঊদ উপলব্ধি করল যে, মূলত আমি তাকে পরীক্ষা করেছি। কাজেই সে তার প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়ল আর আল্লাহর অভিমুখী হল।  —সূরা-সোয়াদ, আয়াত – ২৪

 وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ۞  فَإِنِ اسْتَكْبَرُوا فَالَّذِينَ عِنْدَ رَبِّكَ يُسَبِّحُونَ لَهُ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَهُمْ لَا يَسْأَمُونَ ۞

অর্থঃ তাঁরই নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভূক্ত হলো, রাত, দিন; সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা ‍সূর্যকে সিজদা করোনা এবং চন্দ্রকেও না। বরং সিজদা করো আল্লাহকে, যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন- যদি বাস্তবিকই তোমরা তাঁর ইবাদত করে থাক।  তারপরও যদি তারা (অর্থাৎ কাফেরগণ) অহমিকা প্রদর্শন করে, তবে (তা করতে থাকুক) তোমার প্রতিপালকের কাছে যারা (অর্থাৎ যেই ফেরেশতাগণ) আছে, তারা রাত-দিন তাঁর তাসবীহ পাঠ করে এবং তারা ক্লান্তি বোধ করে না। —সূরা-হা-মীম আস-সিজদাহ্ (ফুছছিলাত) ,আয়াত – ৩৭-৩৮

فَاسْجُدُوا لِلَّهِ وَاعْبُدُوا ۞

অর্থঃ এখন (ও সময় আছে) আল্লাহর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়লো এবং তাঁর বন্দেগীতে লিপ্ত হও।     —আন-নাজ্‌ম – ৬২

وَإِذَا قُرِئَ عَلَيْهِمُ الْقُرْآنُ لَا يَسْجُدُونَ۞

অর্থঃ এবং যখন তাদের সামনে কুরআন পড়া হয়, তখন সিজদা করে না? —সূরা-আল ইন্‌শিকাক, আয়াত – ২১

 كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ۞

অর্থঃ সাবধান! তার আনুগত্য করো না এবং সিজদা করো ও নিকটবর্তী হও।  —সূরা-আল আলাক, আয়াত – ১৯

মনে রাখতে হবে, তিলাওয়াতে সিজদা কেবল তারাবির নামাজেই দিতে হয় বিষয়টি এমন নয়। যেকোনো নামাজে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে নামাজের ভেতর সিজদা করে নিতে হবে। নামাজের সময় ছাড়া অন্যসময় তিলাওয়াত করলেও সিজদা করতে হবে। আল্লাহ সবাইকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

মাওলানা মাহদী হোসাইন

শিক্ষক: মাজহারুল উলুম মাদরাসা, মিরপুর ১, ঢাকা। দাওরায়ে হাদীস ও ইফতা: জামিউল উলুম মাদরাসা, মিরপুর ১৪, ঢাকা। লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। লেখনীর মাধ্যমে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দিতে চান উম্মাহের মাঝে।

Comments (1)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাইট হিট কাউন্টার

সর্বমোট পোস্ট ভিউ: ১,৮৮৫,৭৫৫

পোস্ট কপি করার অপশন বন্ধ রাখা হয়েছে। অনুগ্রহ করে পোস্টের লিংক কপি করুন